ছবিটি প্রতীকী
গৌতম ব্রহ্ম ও নব্যেন্দু হাজরা: চুল্লিতে পুড়ছে প্রিয়জনের দেহ। নেই হরিধ্বনি। নেই মুখাগ্নি। জুটল না গঙ্গাজলও। গীতা, নামাবলি তো দূর অস্ত। আশপাশে নেই শোকগ্রস্ত পরিবারের কেউ। নির্বান্ধবভাবে পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে গেল দেহ। শেষ পর্যন্ত চোখের দেখাও দেখতে পেলেন না কেউ। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত রোগীদের এটাই শেষ পরিণতি। সংক্রমণ ঠেকাতে মৃতদেহ পরিবারের হাতে তুলে দিচ্ছে না প্রশাসন। বরং নির্দিষ্ট স্থানে সবার চোখের আড়ালে সেই দেহ দাহ করা হচ্ছে সরকারের তরফে। যেমনটা আমরা দেখেছিলাম এইচবিও চ্যানেলে চেরনোবিল ওয়েব সিরিজে। সেখানে তুলে ধরা হয়েছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণে মৃতদের কীভাবে প্রশাসনের তরফে সৎকার করা হয়েছিল।
কেউ বা হারিয়েছেন বাবা, মা, কারও বা ছেলে-মেয়ে বা অন্য পরিজন। একদিকে শোক অন্যদিকে ভয়। কাছের মানুষকে হারিয়ে শোকার্ত পরিবার তখন উদ্ভ্রান্ত। শেষকৃত্যে থাকতে না পারার আফসোস। সেই সঙ্গে নিকটাত্মীয়ের আত্মা শান্তি পাবে কি না সেই ভয়। এত কিছুর মাঝেই আবার নিজে আদৌ সুস্থ কি না সেই চিন্তা। ঘরবন্দি থেকেই দুশ্চিন্তায় পরিজনরা। এই পরিস্থিতি কাটাতেই শাস্ত্রের নিয়ম মেনে কুশপুতুলে দাহ করে অন্ত্যেষ্টি করার নিদান দিলেন বৈদিক পণ্ডিত ও পুরোহিতরা। যাতে আত্মার শান্তি এবং মৃতের পরিজনদের মানসিক শান্তি দুই-ই মিলবে। কী সেই নিদান? পণ্ডিতরা বলছেন, মৃতের আত্মার শান্তি এবং নিয়ম-কানুন মানতে ওই ব্যক্তির কুশপুতুল দাহ করা যেতে পারে। তবে মৃতু্যর ঠিক কতদিন পরে দাহ করা হবে, তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে মতান্তর রয়েছে। কিন্তু সবাই মোটামুটি একমত যে যাঁর দেহ পরিজনরা দেখতে পাবেন না, অথচ অন্ত্যেষ্টি হয়ে যাবে, তিনি পরে ওই ব্যক্তি বা মহিলার জামা-কাপড় পরানো কুশপুতুল দাহ করলে মৃত ব্যক্তির আত্মা শান্তি পাবে। যেমনটা প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা মহামারীর ক্ষেত্রে হয়।
পণ্ডিতরা বলছেন, শ্রদ্ধা ইতি শ্রাদ্ধ। করোনায় আক্রান্ত হয়ে যদি কেউ মারা যান, তবে তাঁর পরিজনরা কোয়ারেন্টাইনে থাকবে। তাঁদের মধ্যে সেই শ্রদ্ধা বা ভক্তি তখন আসবে না বা হবে না। সেক্ষেত্রে এই শ্রদ্ধা বা শ্রাদ্ধ তাঁরা মৃত্যুর পর পরই করতে পারবেন না। তাঁরা যখন সুস্থ-সবল হবেন সেই সময় তাঁদের মনের মধ্যে শ্রদ্ধা আসবে। তখন পারলৌকিক ক্রিয়া করতে পারবেন। মৃত ব্যক্তির কুশপুতুলও তখন দাহ করা যাবে। বৈদিক পুরোহিত মহাসংঘের সম্পাদক নিতাই চক্রবর্তী বলেন, “এই করোনা আক্রান্ত রোগীর মৃতু্যর ক্ষেত্রে কোনও পরিজন যদি নিয়ম-কানুন মানতে চান, সেক্ষেত্রে তিনি কুশপুতুল দাহ করতে পারেন। খড়ের একটা পুতুল তৈরি করতে হবে। তাকে জামাকাপড় পরাতে হবে। তার পর সেটা দাহ করতে হবে। সেই সঙ্গে একরাত অশৌচ পালন করতে হবে। যেহেতু করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি যখন মারা যাচ্ছেন তখন তাঁকে পাচ্ছেন না আত্মীয়রা। আর পরিজনরাও অনেকেই কোয়ারেন্টাইনে থাকবেন, তাই তাঁরা সুস্থ হলে পুত্তলিকা দাহ ৪৫ দিনের পরেও করতে পারেন। না হলে হিসাবমতো ১৩ দিনেও করতে পারেন। যদি তাঁরা কোয়ারেন্টাইনে না থাকেন। তাছাড়া শাস্ত্রমতে চৌষট্টি যোগিনীর শান্তি স্বস্তয়ন করতে হবে। তারপর বাড়ির কল্যাণের জন্য শ্যামা স্বস্তয়ন করা জরুরি। এগুলো স্থানীয় পুরোহিতের সঙ্গে কথা বলে করতে পারবেন তাঁরা।”
বেনারসের আচার্য গৌতম ত্রিপাঠীর মতে, আমাদের সমস্ত শ্রাদ্ধাদি স্মৃতির উপর নির্ভর করে। যেমনটা যুদ্ধক্ষেত্রেও তো অনেকসময় দেহ পান না পরিজনরা। যদি তাঁকে না পাওয়া যায়, তবে ১২ বছর পর তাঁর কুশপুত্তলিকাকে দাহ করা হয়। কিন্তু মৃতের অন্য পরিজনরা যদি সুস্থ থাকেন, যখন বডি ছাই হয়ে যাবে তখন তাঁর চিতাভস্মটা নিয়ে এসে চতুর্থীদিবসে গঙ্গায় নিক্ষেপ করতে পারবেন। চতুর্দশ দিবসে নিয়ম মেনেই ঘাটকাজ করা যাবে। তার পরের দিন শ্রাদ্ধ করতে পারবেন। তবে পশ্চিমবঙ্গ পুরোহিত কল্যাণ পরিষদের সম্পাদক সুরজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, “শাস্ত্র হচ্ছে মানুষের পক্ষে। তাই যে কোনও দুর্ভিক্ষ, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, মহামারিতে মৃতের ক্ষেত্রে এই সমস্ত নিয়ম-কানুন করে মানুষকে বিব্রত করার প্রয়োজন নেই।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.