ছবি:ফাইল
কৃষ্ণকুমার দাস: কোভিড আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা রোজ লাফিয়ে লাফিয়ে বৃদ্ধির মধ্যেই মারণ করোনা ভাইরাস সংক্রমণের আরও একটি নতুন দরজা খুলে গেল কলকাতায়। আর এই পথেই সবচেয়ে বেশি বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে শহরের পুলিশ, সিভিক ভলান্টিয়ার, পুর-সাফাইকর্মী ও ফুটপাথবাসীদের। করোনা সংক্রমণের নয়া বাহক হল মহানগরের রাজপথে প্রতিদিন ফেলে দেওয়া হাজার হাজার ব্যবহৃত নানা ডিজাইনের মাস্ক (Mask)।
আনলক হওয়ার পরে সরকারি ও বেসরকারি অফিস চালু এবং শপিং মল ও মার্কেট খুলতেই শহরে মানুষের ঢল নেমেছে। বড়বাজার, ধর্মতলা থেকে শুরু করে অফিসপাড়ার রাস্তায় এবং বাসে মানুষের ভিড় সামাজিক দূরত্ব ভেঙে দিচ্ছে। কিন্তু দিনের শেষে এসপ্ল্যানেড, নিউমার্কেট, গড়িয়াহাট, শ্যামবাজার, হাতিবাগান ও হাওড়া স্টেশনের পাশের বাসগুমটির রাস্তায় পরিত্যক্ত অজস্র মাস্ক লুটোপুটি খাচ্ছে। মাঝে মধ্যে সন্ধ্যার কালবৈশাখী হাওয়ায় অনেক মাস্ক উড়ে গিয়ে অন্য যাত্রীর গায়ে পড়ছে, ঢুকছে অন্য গাড়ির ভিতরে। ধর্মতলা ও বিবাদী বাগ অফিসপাড়া বরো ৬ ও দক্ষিণের গড়িয়াহাট, রাসবিহারী, হাজারা এলাকার সাফাই নিয়ন্ত্রিত হয় বরো ৮ থেকে। আনলক হওয়ার পর এখানেই বহিরাগত মানুষে বেশি এসেছেন। জানা নেই, ভিড়ের মধ্যে কে সংক্রমিত ছিলেন আর কে উপসর্গহীন। ভিড় বাসে উঠতে গিয়ে অনেকের মাস্ক খুলে রাস্তায় পড়েছে। আবার জানলার ধারে বসা কারও মাস্ক অসাবধনতায় উড়ে বাইরে চলে গিয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী গড়িয়াহাট মোড়ের হকার রমেশ নস্করের কথায়,“নতুন মাস্ক কিনে অনেকেই পুরনোটা ছুঁড়ে ফুটপাতের ধারে ফেলে দিয়ে চলে যাচ্ছেন।” মুখে ঘাম হওয়ায় বিরক্তিতে ব্রডস্ট্রিটের নার্সিংহোমের সামনে আয়াকে মাস্ক ফেলে মুখে রুমাল বাঁধতে দেখেছেন পরিচিত হার্ট সার্জন। করোনা আক্রান্ত কোনও ব্যক্তির ফেলে দেওয়া মাস্ক শুধু একজন নয়, অনেকের দেহেই সংক্রমণ ছড়াতে পারে বলে। প্রখ্যাত ভাইরোলজিস্ট ডাঃ অমিতাভ নন্দীর কথায়,“ব্যক্তির মুখের থুথু বা লালারস এবং হাঁছি-কাশি মাস্ককেই আটকে যায়। আর যদি আক্রান্ত ব্যক্তির মাস্ক হয় তবে তো সেটি খুবই বিপজ্জনক। এমন পরিত্যক্ত মাস্ক হাতে ধরে, সেই হাত মুখে বা চোখে দিলেই একেবারে সর্বনাশ।”
কলকাতা পুরসভার ৬ ও ৮, দুই বরোর দায়িত্বপ্রাপ্ত সাফাই অফিসার আলাদাভাবে স্বীকার করেছেন, “মঙ্গল থেকে শনি, শতাধিক পরিত্যক্ত মাস্ক নানা রাস্তা থেকে সরাতে হয়েছে। সতর্কতা হলুদ প্যাকেটে করে বায়ো মেডিক্যাল বর্জ্য হিসাবে পাঠানো হয়েছে।” কিন্তু যে সাফাইকর্মীরা রাজপথে পড়ে থাকা ওই মাস্ক রাস্তা থেকে তুলেছেন তাঁদের কী গ্লাভস পরা ছিল? করোনা সংক্রমণ রুখতে মাস্ক তুলতে যাওয়া সবাই কী পিপিই পরে ছিলেন? দুই প্রশ্নেই বর্জ্য সাফাই বিভাগের শীর্ষ কর্তার উত্তর, “করোনা রোগীর বাড়িতে পিপিই পরে পুরকর্মীরা যাচ্ছেন। রাস্তায় ঝাঁট দেওয়া ও ময়লা সরানোর সময় হাতে গ্লাভস বাধ্যতামূলক।” এদিন নিউমার্কেট, বউবাজার ও গড়িয়াহাট থানার পুলিশ কর্তারা স্বীকার করেছেন, অফিসযাত্রীরাই বেশি মাস্ক ফেলে চলে যাচ্ছেন। কেউ অনিচ্ছাকৃত, কেউ আবার অফিস থেকে রাজ্য সরকার নতুন মাস্ক দিতেই পুরনোটা গাড়ির জানলা দিয়ে ফেলছেন। সিভিক ভলান্টিয়ার, গ্রিন পুলিশরা অনেক সময় সংক্রমণের ঝুঁকির কথা না জেনেই পরিত্যক্ত মাস্ক খালি হাত দিয়েই রাস্তার মাঝখান থেকে একপাশে সরিয়ে দিচ্ছেন। কেউ আবার এগিয়ে নিয়ে পুরসভার ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আসছেন বলে স্বীকার করেন সাউথ-ইস্ট ট্রাফিক গার্ডের এক পুলিশকর্তা।
পরিত্যক্ত মাস্ক থেকে যে নতুন করে শহরে করোনা সংক্রমণের সম্ভাবনা রয়েছে তা এদিন স্বীকার করে উদ্বেগ প্রকাশ করেন কলকাতা পুরসভার মুখ্যপ্রশাসক ও পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম (Firhad Hakim)। রাস্তায় পড়ে থাকা মাস্ক নিয়ন্ত্রণ ও নীতি চূড়ান্ত করতে সোমবার পুরভবনে জরুরি বৈঠক ডেকেছেন মুখ্যপ্রশাসক। ফিরহাদের কথায়,“আইন করে ব্যবহৃত মাস্ক যত্রতত্র ফেলতে নিষেধ করলেই হবে না, মানুষকে বিকল্প সুরহা দিতে হবে। বিদেশে বা দেশের অন্য মহানগরে কীভাবে ব্যবহৃত মাস্ক নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে তা জেনেই কলকাতায় নীতি চূড়ান্ত হবে।” রাস্তায় নানা ধরনের ডিজাইনের সুন্দর সুন্দর মাস্ক পড়ে থাকতে দেখে অনেক ফুটপাথবাসী বা গরিব মানুষ কুড়িয়ে নিয়েও ব্যবহার করছে। কেউ যদি রাস্তা থেকে এমন মাস্ক নিয়ে ব্যবহার করেন তবে করোনাকে সঙ্গে নিয়ে রাতে ঘুমনোর মতো সর্বনাশা সিদ্ধান্ত বলে মনে করেন প্রখ্যাত পালমোনলজিস্ট ডাঃ রাজা ধর। তবে মুখ না ঢেকে, গ্লাভস না পরে এমন পরিত্যক্ত মাস্ক ধরলে সেই সাফাইকর্মী বা পুলিশকর্মীদের সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে সতর্ক করেন তিনি। নয়াদিল্লির এইমসের গবেষণার তথ্য দিয়ে ডাঃ ধর বলেন, ‘এন-৯৫’ মাস্কও ‘আল্ট্রাভায়োলেট রে’ দিয়ে প্রতিদিন পরিশোধন করেও মাত্র পাঁচদিন অন্তর মাত্র পাঁচবার ব্যবহার করা উচিত।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.