স্টাফ রিপোর্টার, নয়াদিল্লি : তৃণমূল কংগ্রেসের (TMC) জাতীয় দলের তকমা কেড়ে নেওয়ার পিছনে বিজেপির (BJP) ষড়যন্ত্রই দেখছে দিল্লির রাজনৈতিকমহল। যা করা হল নির্বাচন কমিশনের মারপ্যাঁচকে সামনে রেখে। যদিও পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে কোনওভাবে পিছপা হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে তৃণমূল। তারা মনে করছে, দলকে খাটো করতেই কমিশনকে দিয়ে এমন পদক্ষেপ করিয়েছে কেন্দ্রীয় বিজেপি নেতৃত্ব। যা নিয়ে তৃণমূল আইনি পদক্ষেপের পথে যেতে পারে বলে ইতিমধ্যে জানানো হয়েছে। পরিস্থিতি পর্যালোচনায় সবরকম সমীকরণ এবং তার ভবিষ্যৎ দলের শীর্ষ নেতৃত্ব খতিয়ে দেখছে বলে জানানো হয়েছে। দলের তরফে জানানো হয়েছে, “সবটাই টেকনিক্যাল বিষয়। অতীতেও এরকম হয়েছে অনেক দলের সঙ্গে। কমিশনের রিপোর্টের পর্যালোচনা করছে শীর্ষ নেতৃত্ব।”
উদ্ভুত পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে জাতীয় নির্বাচন কমিশনের (Election Comission) এমন পদক্ষেপের উদ্দেশ্য নিয়ে। রাজধানীতে যে প্রশ্নগুলি ঘোরাফেরা করছে, তার প্রথমটাই বিজেপি, কংগ্রেসের পর লোকসভায় তৃতীয় বৃহত্তম দল তৃণমূল কংগ্রেস। তার পরও তৃণমূলের জাতীয় দলের মর্যাদা কেড়ে নিয়ে লোকসভায় অস্তিত্বহীন ‘আপ’কে জাতীয় দল করা কি প্রহসন নয়? রাজনৈতিক মহল আরও একটি বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে। তারা মনে করছে, ২০২৪-এ লোকসভা নির্বাচনের আগে দেশজুড়ে বিজেপি-বিরোধী আঞ্চলিক শক্তিগুলিকে একজোট করার কাজে তাৎপর্যপূর্ণ এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে তৃণমূল। এখনই তাকে রুখে বিরোধী ঐক্যে ভাঙন ধরাতে না পারলে বিপদ। সেই বিপদ আঁচ করেই কি তৃণমূলের জাতীয় তকমা কেড়ে নেওয়ার ‘পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র’!
এ নিয়ে বিজেপির আশঙ্কার কথা তুলে তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষ (Kunal Ghosh) বলেছেন, “আপাতভাবে মনে হচ্ছে তৃণমূলকে ভয় পাওয়ার জন্যই যেন পরিকল্পতিভাবে তৃণমূলকে পিছিয়ে দেওয়া হল। লোকসভা ভোটের আগে তৃণমূল বড় শত্রু হিসাবে উঠে আসছে বলে তাদের একটু বিরক্ত করা কিনা, কোনও বিশেষ মারপ্যাঁচে বিশেষ ক্রাইটেরিয়ায় করা হচ্ছে কিনা, এগুলো শীর্ষ নেতৃত্ব দেখবে।” তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব যখন এ নিয়ে দফায় দফায় পর্যালোচনা করছে, তখন অবশ্য কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের পুরনো পর্যবেক্ষণ মনে করিয়ে দিয়েছেন কুণাল। তাঁর সাবধানি মন্তব্য, “সুপ্রিম কোর্টই তো এক সময় বলেছিল যে, নির্বাচন কমিশনে যাদের নিয়োগ হয় তাঁরা নিরপেক্ষ কিনা সেটা দেখতে হবে। তবে আমি সে কথা বলছি না, দল যতক্ষণ না এই রিপোর্ট খতিয়ে দেখে নির্দিষ্ট কোনও সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।” কুণালের কথায়, “অনেক সময় এমন কিছু ঘটে যখন তার সুন্দর অনুভূতি থাকে, আবার কখনও কোনও ষড়যন্ত্র হয়। জীবনে এরকম ওঠাপড়া তো থাকেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এসব প্রতিকূল বিষয় অনেক দেখেছেন।”
পশ্চিমবঙ্গ তৃণমূলের গড়। তার ভিত্তিতে লোকসভা ও রাজ্যসভায় দলের সদস্য সংখ্যাই বলে দিচ্ছে তৃণমূলের শক্তি। ২০১৪ সালে লোকসভায় ৩৪টি আসন জেতে তারা। ২০১৯-এ ফল আশানুরূপ না হলেও এই মুহূর্তে লোকসভায় তাদের আসন সংখ্যা ২৩। অন্যদিকে, গোয়া থেকে রাজ্যসভায় তাদের একজন সাংসদ লুইজিনহো ফেলেইরো ইস্তফা দেওয়ায় সেখানে সাংসদ সংখ্যা এই মুহূর্তে ১২। তার মধ্যে একুশের সব থেকে কঠিন বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপিকে বাংলায় ঠেকিয়ে শুধু রাখেনি তৃণমূল, তাদের কার্যত গোহারা হারিয়ে প্রবল শক্তির পরিচয় দিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল। শুধু তাই নয়, ‘কন্যাশ্রী’, ‘দুয়ারে সরকার’-এর মতো বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর কল্পনাপ্রসূত একের পর এক প্রকল্প জাতীয় ক্ষেত্রে শুধু নয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রথম হয়েছে। এমন একটা দলকে ‘আঞ্চলিক’ করে রেখে সিপিএমের মতো লোকসভায় ৩ সাংসদের দলকে জাতীয় দলের তকমা দিল কমিশন। আম আদমি পার্টির (AAP) লোকসভায় এই মুহূর্তে একজনও সাংসদ নেই। অথচ তারা জাতীয় দলের মর্যাদা পেয়ে গেল! দিল্লির অভিজ্ঞমহল বলছে, ইঙ্গিত স্পষ্ট। তৃণমূলকে খাটো দেখিয়ে বিরোধী ঐক্যে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা চলছে।
এক্ষেত্রে রাজ্যের বাইরে ভোট শতাংশের সহজ হিসাবকে সামনে রেখেছে কমিশন। জানিয়েছে, বাংলার বাইরে অর্থাৎ, ভিনরাজ্যে ৬ শতাংশ ভোট নেই তৃণমূলের। এটা নিয়েই বিতর্ক। রাজনৈতিক মহলের মতে, এই ‘ক্রাইটেরিয়ার’ সমীকরণই এখন কমিশনের সহজ জবাব। তৃণমূলের বক্তব্য, “অন্যান্য রাজ্যের শতাংশ দেখিয়ে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব বিতর্কের মুখে। দেখা যাচ্ছে, যে ‘আঞ্চলিক দলগুলোকে’ নিয়ে টিপ্পনি করা হয়, তারা জেতে। আর জাতীয় দলগুলো হারে।”
দিল্লির রাজনৈতিক মহলের মতে, কমিশনের এই সিদ্ধান্তের পিছনে ষড়যন্ত্রের ভূমিকা থাকা স্বাভাবিক। কারণ, ২০১৬ সালে যখন নির্বাচন কমিশন তৃণমূল কংগ্রেস, এনসিপি (NCP) ইত্যাদি দলগুলিকে জাতীয় দল ঘোষণা করেছিল, তখনই বলা হয়েছিল ১০ বছর বাদে আবার এই সিদ্ধান্ত খতিয়ে দেখা হবে। সেক্ষেত্রে ২০২৬-এ নির্বাচন কমিশনে জাতীয় দলের বিষয়টি মূল্যায়ন করার কথা ছিল। প্রতি বছরই দেশে রাজনৈতিক শক্তির বিন্যাস বদলায়। যে বছর নির্বাচন কমিশনের শক্তির মূল্যায়ন করার কথা, তার তিনবছর আগেই কেন সেটা করা হল, এই প্রশ্ন উঠছে।
এক্ষেত্রেই ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছেন অনেকে। আগামী বছর লোকসভা ভোট। এই ভোটের আগে জাতীয় দলের বিষয়টি টেনে আনা, স্রেফ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বলেই রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একটি বড় অংশের অভিমত। বাংলার নানা জনকল্যাণমুখী প্রকল্পের কথাও স্বাভাবিকভাবেই উঠে এসেছে এই প্রেক্ষিতে। তুলনায় এসেছে যে রাজ্যগুলিতে তথাকথিত জাতীয় দল বিজেপির ‘ডবল ইঞ্জিন’ সরকার রয়েছে তাদের কথাও। কুণালের কটাক্ষ, “দেখা যাচ্ছে যে প্রকল্পগুলির সঙ্গে মানুষের জীবনের সম্পর্ক, সেই কন্যাশ্রী-দুয়ারে সরকারের মতো প্রকল্পে প্রথম পুরস্কার জিতে নিচ্ছে এই ‘আঞ্চলিক দল’ তৃণমূল। আর জাতীয় দলগুলো পিছিয়ে পড়ছে!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.