গৌতম ব্রহ্ম: প্রায় সাড়ে ষোলো মাস হাসপাতালই তাঁর ঘরবাড়ি। সুস্থ হয়ে গিয়েছেন অনেকদিন। পায়ের ভাঙা হাড়ও জোড়া লেগেছে। কিন্তু তার পরেও এনআরএসের অর্থোপেডিক বিভাগে কার্যত ‘বন্দি’ সত্তরের করুণাদেবী।
তাঁর কোথাও যাওয়ার নেই, কিচ্ছু করার নেই। কারণ, বাড়ির লোক তাঁকে নিতে আসছে না। হাসপাতালের তরফে একাধিকবার যোগাযোগর চেষ্টা হয়েছে করুণাদেবীর পরিবারের সঙ্গে। কিন্তু কোনও সাড়া মেলেনি। একপ্রকার নিরুপায় হয়েই এনআরএসের সুপার সৌরভ চট্টোপাধ্যায় সম্প্রতি চিঠি লেখেন রাজ্যের নারী ও শিশু সুরক্ষা সচিবকে। সেখানে বলা হয়েছে, করুণাদেবী এখন বাড়ি যাওয়ার মতো সুস্থ। হয় ওঁকে বাড়ি পাঠানো হোক, নয়তো পুনর্বাসনের জন্য রাখা হোক কোনও বৃদ্ধাশ্রমে।
বাঁ পায়ের ফিমার ভেঙে গিয়েছিল করুণাদেবীর। ছেলে ও ছেলের বউ তাঁকে এনআরএসে ভরতি করে দিয়ে যায়। কিন্তু ওই টুকুই। প্রায় সাড়ে ষোলো মাস বৃদ্ধা হাসপাতালে ভরতি। কিন্তু ছেলে বা ছেলের বউয়ের টিকির দেখাও নেই। বিপাকে পড়েছেন অর্থোপেডিক বিভাগের ডাক্তারবাবুরা। ‘এফওজি৯’ শয্যাটিতে কোনও রোগী ভরতি করতে পারছেন না। সাড়ে ষোলো মাস ধরে তা দখল করে রেখেছেন করুণাদেবী। এই রোগ অবশ্য নতুন নয়। মানসিক হাসপাতালে এমন আকছার হয়। বছরের পর বছর রোগী থেকে যান ইন্ডোরে। কিন্তু বাকি হাসপাতালে সাড়ে ষোলো মাস ধরে রোগী থেকে যাওয়াটা নজিরবিহীন বলেই মনে করছেন ডাক্তারবাবুরা।
হাসপাতালের এক আধিকারিক জানালেন, শুধু যে বাড়ির লোকের জন্য রোগী হাসপাতালে থেকে যান তা নয়, ডাক্তারবাবুদের আলসেমির জন্যও হয়। সম্প্রতি এমন ‘বহুদিন ধরে থেকে যাওয়া’ রোগীদের তালিকা প্রস্তুত করেছে এনআরএস। হাসপাতাল সূত্রের খবর, এই রোগীদের কারও ভরতির দু’মাস পরে অস্ত্রোপচার হয়েছে, কারও বা এক মাস পরে। যেমন ১২ বছরের মাহাজুরা খাতুনের কথাই ধরা যাক। ২৪ সেপ্টেম্বর এনআরএসের নিউরোলজি বিভাগে ডা. সুনীতিকুমার সাহার অধীনে ভরতি হয়েছিল সে। কিন্তু অস্ত্রোপচার হয় ১৫ নভেম্বর। ‘টিবি স্পাইন’ হওয়া বছর উনত্রিশের পারমিতা গাইনও চার মাসের বেশি হাসপাতালে ভরতি ছিলেন। একই ছবি অর্থোপিডেকেও। কেন অস্ত্রোপচারে এত বিলম্ব হচ্ছে, তার কৈফিয়ত তলব করা হয়েছে বিভাগীয় প্রধানদের কাছে। কিন্তু করুণাদেবীর ক্ষেত্রে সমস্যা অদ্ভুত। ছেলে নিতে আসছে না।
করুণাদেবীর মতো রোগীদের ভবিষ্যৎ কী? একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্ণধার নিতাই মুখোপাধ্যায় জানালেন, “অনেক সময় পুলিশের সহযোগিতায় রাস্তা থেকে অনেক দুঃস্থ মানুষকে তুলে নিয়ে হাসপাতালে ভরতি করি। ফলে হাসপাতালের সঙ্গে আমাদের ভাল সম্পর্ক তৈরি হয়। সেই সূত্র ধরেই করুণাদেবীর মতো রোগীদের পুনর্বাসনের জন্য হাসপাতাল অনেক সময় আমাদের সহযোগিতা চায়।” নিতাইবাবুর পর্যবেক্ষণ, বাবা-মা বৃদ্ধ হয়ে গেলে এমনিতেই অনেক ছেলেমেয়ের কাছে বোঝা মনে হয়। তার উপর যদি অসুস্থ হয়, বিছানায় শৌচকর্ম করতে বাধ্য হন, তাহলে তো কথাই নেই। কাঁধ থেকে যেনতেন প্রকারেণ ঝেড়ে ফেলতে চায়। করুণাদেবী সম্ভবত সেই হতভাগ্যদের দলেই রয়েছেন। এই ধরনের রোগীর ক্ষেত্রে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁদের কাউন্সেলিংয়ের চেষ্টা হয়। এক্ষেত্রেও তাই করা হবে। কিন্তু কাজ না হলে সেক্ষেত্রে কোনও হোমে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.