গৌতম ব্রহ্ম: অফার লেটার হাতে সদ্য পেয়েছেন, ফোন বাজল। “তোমার মতো বিলেত ফেরত ছেলেদের আমার দরকার। বিধাননগরে একটা ব্যবস্থা করলাম। পরে একবার দেখা কোরো।” ও প্রান্তে আর কেউ নন, খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee)। একটা চিঠি আর মুখ্যমন্ত্রীর একটা ফোনেই বিলেতের মোটা মাইনের চাকরি ছেড়ে বিধাননগর মহকুমা হাসপাতালে চিকিৎসক হিসাবে কাজ শুরু করলেন ডা. কৌশিক মজুমদার। ইংল্যান্ডে যা পেতেন, তার পাঁচভাগের একভাগ মাইনেতে।
এমআরসিপি, এফআরসিপি করা এই বয়স্করোগ বিশেষজ্ঞ এখন নিয়ম করে রোগী দেখছেন সল্টলেকে। সাহেব-সুবোদের চিকিৎসা করা এই ‘দামী’ ডাক্তারবাবুকে দেখানোর খরচ ফি মাত্র দু’টাকা। তাতে অবশ্য কোনও আক্ষেপ নেই। বরং মুখ্যমন্ত্রীর ফোনের পর কৌশিকবাবুর মনে উড়ান দিয়েছে স্বপ্ন। বিধাননগর হাসপাতালকে বয়স্করোগ চিকিৎসার উৎকর্ষ কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তুলতে হবে। গত জুনে লন্ডনের বিখ্যাত ইলিং হাসপাতালের চাকরি ছেড়ে কলকাতায় (Kolkata) এসেছিলেন। বিলেতের বহু গণ্যমান্য সিনিয়র সিটিজেন কৌশিকবাবুর পেশেন্ট। করোনার (Corona) শুরুর সময় বহু মানুষকে বাঁচিয়েছেন বাগবাজারের এই বাসিন্দা। একটা সময় নিজেও কোভিডের কবলে পড়েছেন।
কৌশিকবাবু বললেন, “১৯৯৮ থেকে ২০০৭, টানা লন্ডনে চাকরি করেছি। তারপর খাপছাড়াভাবে লন্ডন-কলকাতা। বাংলার মানুষদের সেবায় সরাসরি যুক্ত হওয়ার ইচ্ছে ছিল। দেশে ফেরার পর দু’-একজন ডাক্তার বন্ধুকে জানিয়েছিলাম। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আমার স্যর অধ্যাপক ডা. সুকুমার মুখোপাধ্যায় ও রাজ্য মহিলা কমিশনের অধিকর্তা লীনা গঙ্গোপাধ্যায়। কিন্তু ভাবতে পারিনি, মুখ্যমন্ত্রী নিজে আমায় ফোন করে এভাবে চাকরি দেবেন! নভেম্বরে লন্ডনে গিয়ে ফের চাকরিতে জয়েন করার কথা ছিল। মুখ্যমন্ত্রীর ফোনের পর না করে দিয়েছি। এখন বাংলায় থেকেই বয়স্ক মানুষদের চিকিৎসা করব।” খুশি রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা ডা. অজয় চক্রবর্তী। তিনি জানিয়েছেন, কোভিড পর্বে অনেকেই দেশে ফিরে সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবায় যুক্ত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। কৌশিকবাবু তাঁদের মধ্যে অন্যতম। সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেওয়া একজন অ্যানেস্থেটিস্ট এম আর বাঙুর হাসপাতালে নিযুক্ত হয়েছেন। আরও একজন যোগ দেবেন।”
মেডিক্যাল কলেজগুলিতে যোগদানের ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন কমিউনিটি মেডিসিনে ডিএম করা কয়েকজনও। অজয়বাবুর পর্যবেক্ষণ, স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বাংলায় প্রভূত উন্নতি হয়েছে। কোভিড পর্বে দেশ-বিদেশের প্রশংসা কুড়িয়ে নিয়েছে এ রাজ্যের চিকিৎসা পদ্ধতি। কাজের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। তাই বহু চিকিৎসক দেশে ফিরে আসছেন। এ রাজ্যে হাতে গোনা কয়েকজন বয়স্করোগ বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। তা-ও বেসরকারি ক্ষেত্রে। সরকারি ক্ষেত্রে সেই অর্থে কৌশিকবাবুই প্রথম জেরিয়াট্রিশিয়ান। রাজ্যের স্বাস্থ্যদপ্তরের অধীনে কাজ করার অভিজ্ঞতা অবশ্য কৌশিকবাবুর রয়েছে। ১৯৯৮ সালে সেই চাকরি ছেড়ে ইংল্যান্ড পাড়ি দেন উচ্চতর পড়াশোনার স্বার্থে। টানা দশ বছর বয়স্ক রোগ নিয়ে পড়াশোনা করেন। এমআরসিপি, এফআরসিপি হন।
এত বড় বড় ডিগ্রি নিয়ে মহকুমা হাসপাতালে চাকরি? স্বাস্থ্যকর্তারা ভেবেছিলেন, কৌশিকবাবু এই চাকরি কিছুতেই করবেন না। তাছাড়া এখানে রোগী মানে তো সেই ঠ্যালাওয়ালা, রিকশাওয়ালা, রাজমিস্ত্রি আর নিউটাউন-সল্টলেকের কিছু অবসরপ্রাপ্ত মানুষ। কৌশিকবাবুর কথায়, “বিলেতের মোটা মাইনের চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়াটা সহজ ছিল না। কিন্তু টাকাই তো সব নয়। মুখ্যমন্ত্রী নিজে অনেক ত্যাগ করেছেন। সেই মানুষটা যখন বাংলায় থেকে যেতে বলছেন, তখন লন্ডন যাই কী করে?”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.