কৃষ্ণকুমার দাস: বিধানসভার ভিতরে ও বাইরে যাঁরা বামফ্রন্টের মুখ, সেই সুজন চক্রবর্তী, অশোক ভট্টাচার্য, তন্ময় ভট্টাচার্য ও মানস মুখোপাধ্যায়দের কেন্দ্রে বাম প্রার্থী বিপুল ভোটের ব্যবধানে হেরে গেলেন। কংগ্রেস প্রার্থী না থাকায় যাদবপুরে সুজন কোনওক্রমে দলের ভোট দ্বিতীয় স্থানে রাখতে পারলেও অশোক-তন্ময়-মানসদের কেন্দ্রে বাম প্রার্থী তৃতীয় স্থানে চলে গিয়েছেন। নিরাপত্তার সন্ধানে দলের ভোটের একটা বড় অংশ বিজেপি প্রার্থীর পক্ষে চলে গিয়েছে। তার জেরে বামফ্রন্টের প্রার্থীর এমন শোচনীয় পরাজয় বলে মেনে নিয়েছেন বাম পরিষদীয় দলের প্রধান সুজন চক্রবর্তী।
আসলে বাংলাজুড়ে গোপনে এবার বামপন্থীদের প্রচার ছিল, ‘১৯-এ রাম, ২১-এ বাম’। কিন্তু, এই স্লোগান যে সুজন-অশোকদের কেন্দ্রে বুমেরাং হবে তা বুঝতে পারেননি বামেরা। এখানেই শেষ নয়, সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে বামপন্থীদের যে বিশাল প্রভাব ছিল তার প্রতিফলন ঘটত পোস্টাল ব্যালটে। এবার ভোটের ডিউটিতে যাওয়া বাম-কর্মীদের একাংশ পোস্টাল ব্যালটেও প্রার্থীদের সমর্থন না জানিয়ে মোদির ডাকে সাড়া দিয়েছেন।
নির্বাচন কমিশনের বিধানসভা ভিত্তিক ফলাফলে দেখা গিয়েছে, এবার ভোটে বিকাশ ভট্টাচার্যর সৌজন্যে কংগ্রেস প্রার্থী না দেওয়ায় যাদবপুরে বামফ্রন্ট পেয়েছে ৬৮৫১৫ ভোট। সেখানে তৃণমূলের মিমি চক্রবর্তী পেয়েছেন ৮০৬৭০ এবং বিজেপির অনুপম হাজরা পেয়েছেন ৪৮৬৯৬ ভোট। ২০১৬ সালে বিধানসভা ভোটে এই কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রাক্তন মন্ত্রী মণীশ গুপ্ত প্রায় ১৫ হাজার ভোটে হেরে গিয়েছিলেন। এবার সেখানে সুজনের নেতৃত্বাধীন বামকে হারিয়ে তৃণমূল ১২১৫৫ ভোটের মার্জিনে জিতেছে।
উত্তরবঙ্গের বিধায়ক অশোক ভট্টাচার্যর ‘শিলিগুড়ি মডেল‘ মেনে গত বিধানসভা ভোটে কং-বাম জোট হয়েছিল। এবার লোকসভা নির্বাচনে আর জোট হয়নি। নির্বাচনী তথ্য বলছে, জোট হলেও অশোকবাবুর কেন্দ্র শিলিগুড়িতেও বিজেপিকে আটকানো যেত না। কারণ, এবার অশোকবাবুর কেন্দ্রে দলের প্রার্থী সমন পাঠক শুধু হারেননি, ১৩৯০১ ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়েছেন। এই কেন্দ্রে কংগ্রেস প্রার্থী শঙ্কর মালাকার পেয়েছেন মাত্র ৬৬২৬ ভোট। দ্বিতীয় হওয়া তৃণমূল প্রার্থী অমর রাই পেয়েছেন ৩৯৬৬২ ভোট। বিজেপি ১০৫১৪৮ ভোট পেয়েছে।
দমদম উত্তর কেন্দ্রে বিধানসভা ভোটে মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যকে হারিয়ে জিতেছিলেন টিভি চ্যানেলে পার্টির হয়ে বাগ্মী হিসাবে নাম করা তন্ময় ভট্টাচার্য। এবার সেই তন্ময়বাবুর কেন্দ্রেও বাম প্রার্থী নেপালদেব ভট্টাচার্য ৩৫৬০৪টি ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়েছেন। ওই এলাকা থেকে তৃণমূল প্রার্থী সৌগত রায় জিতেছেন ৮৩৯৯৫ ভোটে। ভোটে হারলেও গত তিন বছর এলাকায় পড়ে থাকা চন্দ্রিমা জানিয়েছেন, শুধু তৃণমূল জেতেনি, বামেদের ট্র্যাডিশনাল বহু ওয়ার্ড থেকেও এগিয়ে ছিলেন সৌগত রায়। যেমন ১৫ নম্বরে সুনীল চক্রবর্তীর ওয়ার্ড। স্বাধীনতার পর কখনওই অ-বাম কেউ জেতেনি। সেখানে এবার তৃণমূল জিতেছে, বামেরা তৃতীয় হয়েছে। উত্তর দমদম পুরসভার ৩৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৬-৭টি বাদ দিয়ে সবকটিতেই জিতেছে তৃণমূল, তৃতীয় কাস্তে-হাতুড়ি-তারা।
কামারহাটিতে প্রাক্তন মন্ত্রী মদন মিত্রকে হারিয়ে বিধানসভা ভোটে জিতেছিলেন ময়দানের মানুষ ও প্রাক্তন বাম মন্ত্রী মানস মুখোপাধ্যায়। কিন্তু এবার লোকসভা ভোটে তাঁর কেন্দ্রেও পার্টির প্রার্থী তৃতীয় হয়েছে। সৌগত রায় পেয়েছেন ৬৩৩৫৬ ভোট আর বাম প্রার্থী পেয়েছেন মাত্র ২১৪৩৩ ভোট। এখানেও বিজেপির শমীক ভট্টাচার্য ৪৫৬৩১ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছেন। আরএসপি-র হয়ে এখনও বার্ধক্যকে উড়িয়ে দিয়ে বিধানসভায় যিনি গলা ফাটান সেই বিশ্বনাথ চৌধুরির বালুরঘাটেও বাম প্রার্থী রণেন বর্মন শুধু হেরে যাননি, ১৪৭৯৮ ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়েছেন। তাঁর কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী অর্পিতা ঘোষের চেয়ে বিজেপি প্রার্থী সুকান্ত মজুমদার প্রায় দ্বিগুণ ভোট পেয়েছেন। দক্ষিণ ২৪ পরগনার কুলতলিতে গত বিধানসভা ভোটে জিতেছিলেন সিপিএমের রামশঙ্কর হালদার। এবার লোকসভা ভোটে সেখানে বাম প্রার্থী প্রাক্তন সেচমন্ত্রী সুভাষ নস্করের জামানত কার্যত জব্দ হয়ে গিয়েছে। কুলতলিতে জয়নগর কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী প্রতিমা মণ্ডল পেয়েছেন ৮৭১০৬ ভোট, সেখানে সুভাষ পেয়েছেন ১০১২৫ ভোট।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.