প্রতীকী ছবি।
রমেন দাস: যাদবপুর না আতঙ্কপুর! একথা আমরা বলছি না, বলছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee)। কিন্তু সরকার-প্রশাসনের বাইরেও অভিযোগ উঠছে একাধিক। যাদবপুরের হস্টেল বিভীষিকা নিয়ে চর্চা হচ্ছে সর্বত্র। তাহলে কি সত্যিই বাইরের যাদবপুর (পড়ুন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়) আর ভেতরের যাদবপুর সম্পূর্ণ আলাদা? নদীয়ার বগুলার বাসিন্দা নাবালক ওই ছাত্রের মৃত্যু প্রশ্নেই জর্জরিত হয়েছে দেশের পাঁচতারা এই বিশ্ববিদ্যালয়।
কতটা সত্যি এই অভিযোগ? সোশ্যাল মিডিয়া খুললেই যাদবপুরের (Jadavpur University) পুকুরপাড় থেকে গ্রীনজোন, ক্যান্টিন-সহ একাধিক বিচরণ ক্ষেত্র। দিকে দিকে ‘মাদকদ্রব্য’, ‘অশালীনতা’র অভিযোগের অট্টালিকা প্রকাশ হচ্ছে! কোনটা ঠিক কোনটা ভুল আমরা নিশ্চিত না হলেও এক ছাত্রের মৃত্যুর সঙ্গেই উঠে আসছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রথম সারিতে থাকা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কুকীর্তি’ও। সন্তান হারিয়ে বাবা বলছেন, ”নোংরামি ঢাকতেই খুন করা হয়েছে ছেলেকে (Jadavpur Student Death) !” চড়েছে হাহাকারের পারদ। কালিমালিপ্ত হয়েছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়।
এই প্রশ্ন নিয়েই এইটবি ছাড়িয়ে বাংলা বিভাগের (Bengali Department JU) পাশ থেকে খানিকটা এগনো শুরু করতেই একের পর এক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চেষ্টা করছিলাম আমরা। কী হচ্ছে ভেতরে? বাইরে শোরগোল, একাধিক ছাত্র সংগঠনের তোলপাড় সৃষ্টি করা আন্দোলনের আওয়াজ কি পৌঁছচ্ছে যাদবপুর-গর্ভে?
একটু এগোতেই সাধারণ পড়ুয়াদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা শুরু করলাম আমরা। কিন্তু প্রথমেই হোঁচট! ”দাদা আমাকে ছেড়ে দিন! আমি এই বিষয়ে কিছু বলব না!” ভয় পাচ্ছেন? ”হ্যাঁ দাদা। সব মিটে গেলেও এখানেই পড়তে হবে আমাদের!” সটান বলে দিলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ছাত্র। সমাজবিদ্যা বিভাগের ওই ছাত্রের চোখেমুখে যেন তখনও আতঙ্ক!
কিন্তু কেন? এই যাদবপুর তো সাহসের কথা বলে বারবার! এই বিশ্ববিদ্যালয় মেধার পাহাড় জমায়। তবুও? ঠিক এই প্রশ্নের উত্তরেই আরও বিস্ফোরক আর এক ছাত্র। ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা যেন তাঁর! বেদনাতুর হৃদয়েই তাঁর দাবি, ”আমরা মুখ খুলব না। যাঁরা বলছেন, এঁরা সকলেই রাজনৈতিক মুখ। ওঁরা নিরাপদ। আর আমাদের কিছু হলে, এর দায় নেবেন?” চমকে গিয়েছিলাম আমরাও। যে অরবিন্দ ভবনের সামনের স্লোগান কাঁপিয়ে দিচ্ছে এলাকা। তার পিছনেই এই অন্ধকার কেন?
যে যাদবপুর পথ দেখায় বলে দাবি করে। সেই যাদবপুরে একটি নৃশংস মৃত্যুর পরের অবস্থা কি শোচনীয়? পেশাগত তাগিদে হাঁটতে হাঁটতে ‘নতুন অভিজ্ঞতা’ নিয়েই পৌঁছে গেলাম অরবিন্দ ভবনের পিছনের ক্যান্টিন চত্বরে। এই জায়গাটি মূলত ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের পড়ুয়াদের আড্ডার জায়গা। কিন্তু সেখানেও প্রায় একই ছবি। মুখ খুলছেন না কেউ! সকলেই যেন এক ‘স্বপ্ন-শেষে’ সিঁটিয়ে রয়েছেন।
এ কী হল যাদবপুরে? অবশেষে খোঁজ পেলাম কয়েক জনের। কিন্তু সেই একই। এঁরা পোস্টার লিখছেন। অর্থাৎ কোনও না কোনও সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে। কী বললেন ওঁরা? ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের এক ছাত্র বললেন, ”ভয় পাচ্ছে ছোটরা (নবাগত) আমরাও বুঝতে পারছি। জানি ক্যাম্পাস জুড়ে এমন একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছে। একটা ভিন্ন আবহ সৃষ্টি হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে। ঘৃণ্য, পৈশাচিক ওই ঘটনার বিচার চাই আমরাও। আর বলব, তোরা (নবাগত) ভয় পাস না, আমরা তোদের সঙ্গে আছি!”
খানিকটা আশ্বস্ত হলাম আমরাও। অবশেষে মুখ খুলছেন কেউ কেউ। একই বিভাগের আর এক ছাত্রের কথায়, যা হয়েছে এটা তো ভয় পাওয়ার মতোই। ছোটরা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেই এমন অভিজ্ঞতা রপ্ত করছে। এর চেয়ে বেদনার আর কী হতে পারে!” কিন্তু অনেকেই রেকর্ড শেষে বলছেন, ”দাদা নাম লিখবেন না প্লিজ!”
ওঁরা সঙ্গে আছেন ওঁদের! কিন্তু মফস্বল থেকে আসা ওই ছাত্রের সঙ্গে ছিলেন না কেন? এই প্রশ্নের অন্দরেই আমরা ঢুকে পড়লাম বহু আলোচিত বাংলা বিভাগের মধ্যে। সেখানে তো আরও বিপদ! স্বয়ং বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক জয়দীপ ঘোষ বলছেন, “ওই ঘটনার পরে স্বাভাবিকভাবে ভয়ে সিঁটিয়ে আছেন নতুন আসা ছাত্রী-ছাত্রীরা, আমরা বারবার বলছি। বোঝাচ্ছি। এমন ঘটনার অভিযোগ অর্থাৎ র্যাগিং নিয়ে অভিযোগ শুনেছি। প্রতিবাদ আমরাও করেছি। বলেছি পাশে আছি। কিন্তু দায় তো আমাদের সবারই তাই না!”
এতদিন পর বুঝলেন? স্বপ্ন-শেষের আগে বলেছিলেন? ”বুঝতে পারিনি, কীভাবে বুঝব বলুন তো!” বলতে বলতে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললেন আর এক অধ্যাপক সুমিত বড়ুয়া। “বিশ্বাস করুন, ওই দৃশ্য দেখতে পারছিলাম না। এই কষ্ট রাখার জায়গা নেই! কী মর্মান্তিক! এর বিচার চাই!” অধ্যাপকের রেশ টেনে বাংলা বিভাগের ছাত্র সায়ন নন্দীর দাবি, “ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমরা আছি! এর পুনরাবৃত্তি আর হবে না বলেই আশাকরি। এই জিনিস তো একটা সামাজিক ব্যাধি, এর নিরসন প্রয়োজন।” প্রায় একই সুর বাংলা বিভাগের ছাত্র শুভদীপ মৃধার। তিনি বলছেন, “হস্টেলে এসব হয়, আমরাও জানি। একাধিকবার অভিযোগেও কোনও সুরাহা হয়নি। কিন্তু আমরা ছোটদের সঙ্গে আছি।”
ওঁরা পাশে আছেন। কিন্তু সেদিন হস্টেলের ব্যালকনিতে সব স্বপ্ন শেষ হওয়ার মুহূর্তের আগে কেন আভাস পাননি সকলে? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইমনকল্যাণ লাহিড়ী বলছেন, “ছাত্ররা সব বিষয়ে বিক্ষোভ করেন একথা ঠিক নয়। এমন ঘটনার মুখোমুখি আগেও হয়েছি আমরা। অভিযোগ গিয়েছে। ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের গাফিলতি সর্বত্র। সিসিটিভি যেখানে লাগানো উচিত, সেখানে কেন হয়নি?”
ছাত্রনেতা অনুষ্টুপ চক্রবর্তী ‘আশ্বস্ত’ করেছেন তাঁর, ‘সহপাঠী ভাই-বোনদের’। তিনি বলছেন, “যে ঘটনা ঘটেছে আমরা লজ্জিত। এর বিচার চাইছি। যে বা যারা এই নৃশংস কাজ করে, এদের ধরা হোক। শুধুই সৌরভ একা নয়, আরও বড় মাথা রয়েছে। তাদেরও গ্রেপ্তার করা হোক।” খোদ ওই ছাত্রনেতার দাবি, “কিন্তু ক্যাম্পাসে এমন ঘটনার অভিযোগ উঠলেও ব্যবস্থার ক্ষেত্রে গাফিলতি ছিল। আমরা আর এসব হতে দেব না। আরও আন্দোলন চলবে। এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না! যারা এর সঙ্গে জড়িত সকলের শাস্তি চাই।”
বাম ছাত্র সংগঠনের আরও এক নেত্রী তথা যাদবপুরের ছাত্রী আফরিন বলছেন, “আমরা এই ঘটনার প্রতিবাদ বারবার করেছি। নির্দিষ্ট কেউ কেউ এমন ঘটনাকে ইন্ধন দিয়েছেন বারবার। হস্টেলে নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু আমরা নবাগতদের পাশে আছি। ভয় পেয়ো না।”
কিন্তু এই বছর যাঁরা পড়তে এসেছেন স্বপ্ন নিয়ে বিস্তর। তাঁরা কী বলছেন? অনেক খুঁজে এমনই এক ছাত্রীর খোঁজ পেলাম আমরা। তিনি বললেন, ”এই ঘটনার বিচার চাই। আমরা নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছি, পড়াশোনা করব বলে। অনেক দূরে বাড়ি। আজও হস্টেল পাইনি। আশাকরি নিরাপদে পড়াশোনা করতে পারব, কিন্তু আমাদের সহপাঠীর মৃত্যুর বিচার হোক!”
আর কর্তৃপক্ষ? যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে বারবার? সেই রেজিস্ট্রার স্নেহমঞ্জু বসু বলছেন, “আমি নিজে দেখছি! ছুটিতে ছিলাম। শরীর ভাল ছিল না। প্রথম বর্ষের পড়ুয়াদের আলাদা হস্টেলে রাখার ব্যবস্থার কথা ভাবছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা আরও জোরদার করার কথা ভেবেছি। আমি নিজেও হস্টেল পরিদর্শনে যাচ্ছি।” ওঁরা (নবাগত) যে ভয় পাচ্ছেন, একথা স্বীকার করে নিয়েছেন রেজিস্ট্রারও।
কিন্তু কোথায় ছিলেন এতদিন? আমরা নই, জিজ্ঞাসা করছেন ওঁর ছাত্ররাই। ওঁরা নিরাপদ কিনা জানি না আমরা! কিন্তু একাধিক ছাত্রসংগঠনের মতভেদ, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব আর অভিযোগ-পালটা অভিযোগে উঠে আসছে একের পর এক প্রশ্ন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মহানতার বাইরেও উঠছে নানাবিধ অভিযোগ। কলঙ্কিত হয়েছে স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান, বলছেন প্রাক্তনীরাও। ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা থেকে শুরু করে হস্টেলে ‘গাঁজা’ সেবন, র্যাগিং, মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ! একটি মৃত্যু ফের তুলেছে বহু প্রশ্ন। কিন্তু যে প্রতিবাদ অরবিন্দ ভবনের বাইরে অথবা ৪ নম্বর গেটের বাইরে হিল্লোল তুলছে বারবার, সেই শব্দ শুনে ওঁরাও সাহস পাচ্ছেন কি? উত্তর কিন্তু এখনও অধরা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.