সন্দীপ চক্রবর্তী: উত্তর ও মধ্য কলকাতার দাপুটে নেতা থেকে রাজ্যের কংগ্রেসি রাজনীতির ‘শেষ কথা’। সোমেন মিত্রর (Somen Mitra) রাজনৈতিক জীবন কম বর্ণময় নয়। দীর্ঘ ৫ দশকের রাজনৈতিক জীবনে বহুবার জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হলেও, সেভাবে প্রশাসনিক ক্ষমতা কোনওদিনই পাননি। আবার এই দীর্ঘ সময় কখনও নিজেকে বেশিদিন সাংগঠনিক ক্ষমতা থেকে দূরেও রাখতে পারেননি। নিন্দুকেরা বলেন, সোমেনের সঙ্গে বিবাদের জন্যই কংগ্রেস (Congress) ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন মমতা। সিপিএমের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গেও নাকি সখ্য ছিল তাঁর। অথচ সোমেনের ঘনিষ্ঠরা বলেন, এসব সত্য নয়।
সালটা ২০০৮। সিঙ্গুর আন্দোলন ঘিরে বঙ্গ রাজনীতি তখন উত্তাল। রাজ্যে পরিবর্তনের হাওয়া ইতিমধ্যেই বইতে শুরু করেছে। সিঙ্গুরে তৎকালীন বাম সরকারের শিল্পায়ন নীতির বিরুদ্ধে ধরনায় বসেছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতার (Mamata Banerjee) পাশে ছোট্ট একটা মঞ্চে ধরনায় বসতে দেখা যেত সোমেন মিত্রকেও। ‘ছোড়দা’ তখনও তৃণমূলে যোগ দেননি। প্রগতিশীল ইন্দিরা কংগ্রেসের নেতা তিনি। ধর্মতলার সেই ধরনামঞ্চে তখন সারা বাংলার কংগ্রেস-তৃণমূল কর্মীরা আসতেন। অনেককেই দেখা যেত মমতার সঙ্গে দেখা করার পর সোমেন মিত্রর সঙ্গে কথা বলতে।
আসলে, সেসময়ই মমতার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করার অঙ্গীকার করে ফেলেছিলেন তিনি। পরে তৃণমূলে যোগ দেন। কিন্তু, সেখানে বেশিদিন দলে স্থায়ী হতে পারেননি। মমতা যখন ক্ষমতার মধ্যগগনে, তখন স্রোতের বিপরীতে গিয়ে তৃণমূল ছাড়েন সোমেন মিত্র। আসলে, তৃণমূলে থাকাকালীন সম্মান পেলেও সাংগঠনিক ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিলেন না। আর সোমেন মিত্র কখনও প্রশাসনিক ক্ষমতার বৃত্তে পৌঁছতে না পারলেও, সাংগঠনিক ক্ষমতা থেকে নিজেকে বেশিদিন দূরে রাখতে পারতেন না। সেজন্যই হয়তো কংগ্রেসে থাকাকালীন অধীর চৌধুরি, প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সিদের সঙ্গে মতবিরোধ হয়েছে সোমেন মিত্রের।
একেবারে রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই সাংগঠনিক কাজ, সাংগঠনিক ক্ষমতা (Siddhartha Shankar Ray) দুটোই বেশি পছন্দ করতেন সোমেন। সাতের দশকে বঙ্গ রাজনীতি যখন উত্তাল তখন সিদ্ধার্থশংকর রায়ের হাত ধরে লাইমলাইটে আসেন। সেসময় গোটা উত্তর ও মধ্য কলকাতা দাপিয়ে বেড়াতেন সোমেন। তৎকালীন ‘ভদ্র’ কংগ্রেসি নেতাদের অনেকেই সোমেনের কাজের ধরন পছন্দ করতেন না। কিন্তু সেটা তাঁর রাজনৈতিক কেরিয়ারে অন্তরায় হয়নি। আসলে সোমেনকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন বরকত গনি খান চৌধুরি (A. B. A. Ghani Khan Choudhury)। ১৯৭২ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে সাতবার শিয়ালদহ কেন্দ্রের বিধায়ক হয়েছেন ‘ছোড়দা’। অবশ্য বিধায়ক হওয়ার পরও বিধানসভার থেকে সাংগঠনিক কাজেই বেশি দেখা যেত তাঁকে।
একটা সময় বাংলার প্রতিটি বুথের কংগ্রেস কর্মীদের নাম ধরে চিনতেন তিনি। অনেকেই অতুল্য ঘোষের পরে বঙ্গ কংগ্রেসের সেরা সংগঠক মনে করতেন সোমেন মিত্রকে। নয়ের দশকের শেষের দিকে রাজ্যজুড়ে তুমুল জনপ্রিয়তা সত্বেও প্রদেশ সভাপতির নির্বাচনে সোমেনের কাছে হেরে যান মমতা। পরে আলাদা দল তৈরি করে মমতা আজ রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান। কিন্তু সোমেনকে প্রশাসনিক ক্ষমতা ততটা টানত না। তাঁকে টানত সাংগঠনিক ক্ষমতা। সেজন্যই হয়তো, ১৯৯৮ সালে প্রদেশ সভাপতির পদ ছাড়ার পর কংগ্রেস কার্যালয়ে যাওয়া একপ্রকার বন্ধই করে দিয়েছিলেন। সেজন্যই হয়তো প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির সঙ্গে বিবাদ। সেজন্যই হয়তো রাজনৈতিক অনুগামী অধীর চৌধুরির সঙ্গে মতের মিল হয়নি। অধীর প্রদেশ সভাপতি থাকাকালীন সোমেন বিধান ভবনে একেবারেই যেতেন না। ২০১৮ সালে পুনরায় প্রদেশ সভাপতি হওয়ার পর প্রবেশ তিনি করেছিলেন বিধান ভবনে। আজীবন সংগঠন ভালবেসেছেন। আর রাজ্যে দলের সাংগঠনিক শীর্ষপদে থাকাকালীনই মৃত্যু হল তাঁর। অনেকে বলছেন, ‘সোমেনদা’র রাজনৈতিক জীবনের একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হল।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.