অর্ণব আইচ: ‘টিপিক্যাল হার্ট অ্যাটাক’ নয়। বাঁদিকের ধমনীতে থাকা ৭০ শতাংশ ব্লকেজই কাল হল কেকে’র। অতিরিক্ত উত্তেজনায় সেই ব্লকেজ বেড়ে আচমকাই বন্ধ হয়ে যায় রক্ত চলাচল। পরিণতি, কার্ডিয়াক অ্যাটাক এবং প্রথিতযশা এই শিল্পীর অকাল প্রয়াণ। মঙ্গলবার নজরুল মঞ্চে অনুষ্ঠান করে ফেরার পর হোটেলেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে প্রয়াত কেকে’র ময়নাতদন্তের রিপোর্টে উঠে এসেছে এমনই তথ্য। এসএসকেএম হাসপাতালের ওই রিপোর্ট বলছে, অসুস্থ ছিলেন কৃষ্ণকুমার কুন্নাথ ওরফে কে কে (Singer KK)। কিন্তু যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করেননি।
জানা গিয়েছে, কলকাতায় আসার পর শারীরিক অসুস্থতার কথা ফোন করে স্ত্রীকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু আপাদমস্তক পেশাদার এই শিল্পী তাঁর ‘কমিটমেন্ট’ পূরণে পিছিয়ে যাননি। নির্ধারিত দু’দুটি লাইভ পারফরম্যান্স করার ফাঁকে এমনকী দীর্ঘদিনের ছায়াসঙ্গী ম্যানেজার হিতেশ ভাটকেও তাঁর অসুস্থতা জানতে দেননি। এসএসকেএমের রিপোর্ট বলছে, ‘টিপিক্যাল হার্ট অ্যাটাকে’ মৃত্যু হয়নি কেকে’র। তাঁর বিভিন্ন ধমনী ও উপধমনীতে একাধিক ছোট ছোট ব্লকেজ ছিল। বাঁদিকের মূল ধমনীতে ব্লকেজ ছিল কমবেশি ৭০ শতাংশ। মঙ্গলবার রাতে অতিরিক্ত উত্তেজনায় সেই ধমনীতেই আচমকা রক্ত চলাচল বন্ধ হওয়ায় অনিয়মিত হয়ে পড়ে শিল্পীর হৃদস্পন্দন। সেই সময় তাঁকে ‘সিপিআর’ দেওয়া যায়নি বা হয়নি। সেটা দেওয়া গেলে হয়তো বাঁচানো যেত বলে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের মত। পরিণতি, ‘কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে’ জীবনাবসান হয় শিল্পীর।
অস্বস্তি থাকলেও মঙ্গলবার রাতে পেশাদারিত্ব অটুট রেখেই নজরুল মঞ্চে পারফর্ম করছিলেন শিল্পী। তাঁর ম্যানেজার জানিয়েছেন, গরম ছিল নজরুল মঞ্চে, ওঁকে জল খেতে হচ্ছিল বারবার। তবু কষ্ট বুঝতে দেননি কাউকেই। টানা দেড় ঘণ্টা হাসিমুখে গান গেয়েছেন। হোটেলের লবিতে ভক্তদের সেলফির আবদার মিটিয়েছেন। ঘরে ফিরে লুটিয়ে পড়েছেন। বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যেতেই সব শেষ।
তার আগে কে কে ছিলেন স্বমেজাজে। দমফাটা ভিড়, অসহ্য গুমোট। ঘামে ভেজা সপসপে জামা অবজ্ঞা করেই মঙ্গল সাঁঝবেলা নজরুল মঞ্চ দাপিয়ে গিয়েছেন কৃষ্ণকুমার কুন্নথ। দর্শকদের মনোরঞ্জন করতে গানের তালে তালে নিজে নেচেছেন। দর্শকদের কোমর দুলে উঠেছে তাঁর কণ্ঠের ছন্দে। উদ্দামতার মধ্যে দর্শকরা খেয়ালও করেননি প্রিয় গায়ক ক্লান্ত, কিন্তু পেশাদারিত্বে মারাত্মক নিখুঁত, ত্রুটিহীন। চেয়ারের থেকে দর্শক বেশি ছিল। ক্ষমতা হারিয়েছিল এসি মেশিন।
তাপমাত্রা সামান্য যাতে কমে, কেকে উদ্যোক্তাদের কাছে অনুরোধ করেছিলেন, স্পটলাইট নেভানোর। তবু এক মুহূর্তের জন্যও ছেড়ে যেতে চাননি অনুষ্ঠান প্রাঙ্গণ।পেশাদারিত্বের টান এমনই। হাসপাতালের পক্ষ থেকে জানানো হয়, রাত ১০টা নাগাদ যখন নিয়ে আসা হয় কেকে’কে তখন তাঁর ছায়াসঙ্গী ছিলেন ম্যানেজার। সংজ্ঞাহীন কৃষ্ণকুমার কুন্নথের কবজিতে হাত ছুঁইয়ে দেখা যায়, হৃদস্পন্দন নেই। দ্রুত ইসিজি করাতেই কাটে ধন্দ। রেখা তো টানটান সোজা-সরল। অর্থাৎ বুকের ধুকপুকুনি বন্ধ হয়ে গিয়েছে বহু আগেই।
একটা নয়, তিলোত্তমায় কেকে পা রেখেছিলেন একাধিক অনুষ্ঠানের বরাত নিয়ে। সোমবারও গান গেয়েছেন সারা সন্ধে। রাতে সামান্য বিশ্রাম নিয়ে ফের মঙ্গলবার উঠে পড়েছেন মঞ্চে। কেকে’র স্ত্রী জ্যোতি লক্ষ্মী কৃষ্ণা জানিয়েছেন, শরীরটা জুতে ছিল না অনেকদিন ধরেই। মুম্বই ছাড়ার আগেই ব্যথা ছিল হাতে। তবু উদ্যোক্তাদের তা বলতে রাজি ছিলেন না। চিকিৎসকরা বলছেন, হৃদরোগের প্রাথমিক উপসর্গ এই হাত ব্যথা। “অগ্রিম নেওয়া হয়ে গিয়েছে। পারফর্ম আমি করবই।” এমনটাই বলতেন বারবার।
গায়ক শিলাজিৎ মজুমদার, ইমন চক্রবর্তী জানিয়েছেন, আমাদের সঙ্গেও বহুবার এমনটা হয়েছে। গরমে, ঘেমে নেয়ে একশা। তাও দর্শকরা একের পর এক অনুরোধ করে চলেন। ওঁদের মুখের দিকে তাকিয়েই মঞ্চ ছাড়তে পারি না। যেমনটা করলেন প্রয়াত গায়ক। নিজের জীবন দিয়ে পেশাদারিত্বের প্রমাণ দিয়ে গেলেন কৃষ্ণকুমার কুন্নথ।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.