ক্ষীরোদ ভট্টাচার্য: দুই দাদার ধ্যানজ্ঞান লেখাপড়া। বরাবর প্রথম। কিন্তু ছোট ছেলে শ্যামল বইয়ের ধার দিয়ে যায় না। রাতদিন কাদামাটি দিয়ে পুতুল গড়ে। রাগ করে বাবা একদিন বেদম মারধর করে ঘরে আটকেও রাখেন। ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ বুঁদ হয়ে থাকা সেদিনের সেই শ্যামল অধিকারীর তৈরি কাঠের গুঁড়োর দুর্গা প্রতিমা কয়েক বছর ধরে বিদেশে গিয়েছে। কলকাতার কয়েকটি নামী পুজোতেও দেখা গিয়েছে। কিন্তু মেলেনি প্রাপ্য সান্মানিক। তবে এবার পুজোয় রাজ্য সরকারের বিশ্ববাংলা বিপণীগুলিতে শোভা পাবে শ্যামলবাবুর তৈরি সেইসব প্রতিমাই।
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বারুইপুরের মালঞ্চর বাসিন্দা শ্যামলবাবুর শিল্পী থেকে ভাস্কর হয়ে ওঠার জার্নিটা সহজ নয়। চিত্র শিল্পী হয়ে ওঠার জন্য দক্ষিণ কলকাতার একটি বেসরকারি স্কুলে পড়া শুরু করেছিলেন তিনি। কিন্তু চরম অর্থসঙ্কটে ফাইনাল পরীক্ষায় বসতে পারেননি। বারুইপুর বাসস্ট্যান্ডের কাছে তাঁর পুরো বাড়িটাই আস্ত একটা স্টুডিও। পলেস্তারা খসা দেওয়ালে মেরামতের অভাবে শ্যাওলা জমেছে। কিন্তু ঘরের দেওয়ালে রঙিন চিত্র। পাশে বসে কথা বললেও সহজে শোনা যায় না, এতটাই আস্তে কথা বলেন তিনি। কিন্তু জেদ ভয়ংকর। চিত্র শিল্পীরা ভাস্কর হতে পারে না, শুধুমাত্র এমন ঠাট্টার জন্য নামী বিজ্ঞাপণ সংস্থার দামি চাকরি এককথায় ছেড়ে বাড়ি এসে কাদা-মাটি দিয়ে বিভিন্ন অবয়ব তৈরি শুরু করেন শ্যামলবাবু। ধীরে ধীরে রং-তুলিকে সরিয়ে রেখে মূর্তি তৈরির কাজকেই বেছে নেন। কিন্তু মাটির প্রতিমা ভারী। তাই এমন একটা মাধ্যম চাইছিলেন যা দীর্ঘস্থায়ী হয়। শ্যামলবাবুর কথায়,“অনেক কিছু খুঁজেছি। এমনকি স্ত্রী মালবিকা রুটি তৈরির জন্য আটা মেখে রেখে দিলেও তার সঙ্গে তুঁতে মিশিয়ে পুতুল গড়েছি। ও খুন্তি নিয়ে তেড়ে এসেছে। রাতে কারও খাওয়া হয়নি।” সাত-আট বছর এমন পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে করতে কাঠের গুঁড়োর সঙ্গে তুঁতে ও আঠা মিশিয়ে মূর্তি তৈরি করে ফেললেন তিনি।
এখন যেন পরশপাথর হাতে পেয়েছেন তিনি। যেমন টেকসই, তেমনই হালকা। কাঠের গুঁড়ো দিয়ে একের পর এক পুতুল তৈরি শুরু করেছেন তিনি। কিশোর বয়সে বারুইপুরের পদ্মপুকুরে একটি ক্লাবের পুজোয় নবদুর্গা তৈরি করে প্রচুর অর্থও পেয়েছিলেন শ্যামলবাবু। প্রতিমা দেখার থেকেও বেশি ভিড় হয়েছিল তাঁকে দেখতে। সেদিনের সেই নবীন শিল্পীর কাঠের প্রতিমা রাজ্য সরকারের হস্তশিল্প মেলায় বরাবর প্রথম স্থান দখল করে। প্রতিমায় মুগ্ধ হয় সরকারি আধিকারিক থেকে শিল্প রসিকরা। মূলত, তাঁদের উদ্যোগেই এবার বিশ্ববাংলার জন্য দুর্গা তৈরি করেছেন শ্যামলবাবু। ইতিমধ্যেই পনেরোটি প্রতিমা তিনি পাঠিয়ে দিয়েছেন বিশ্ববাংলা বিপণীতি। বাকিগুলি তৈরির কাজ চলছে। এইসব প্রতিমার বিশেষত্ব হল, কোনও ছাঁচ ব্যবহার হয়নি। পুরোটাই হাতে তৈরি। শ্যামলবাবুর কথায়, “আমার তৈরি সিংহের মুখের আদল খুঁজতে চিড়িয়াখানা পর্যন্ত গিয়েছি। যা বাস্তব তাই তৈরি করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। কতটা ঠিক তা সময় বলবে।” একেকটি প্রতিমা তৈরি করতে অন্তত একমাস সময় লাগে। তাই এবার আর কলকাতার কোনও পুজোর কাজের বরাত নেননি।
রাতের পর রাত জেগে কাজ করায় মাঝে-মধ্যেই শরীর বিদ্রোহ করে। কিন্তু বিশ্ববাংলা বিপণীতে কাছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মূর্তি পৌঁছে দিতে হবে, তাই এখন তাঁর বিশ্রাম নেওয়ার সময় নেই। শিল্প রসিকদের কাছে শ্যামল অধিকারী পরিচিত নাম। কিন্তু তাতে অর্থাভাব কমেনি। একমাত্র ছেলে স্থাপত্যবিদা নিয়ে হরিয়ানায় লেখাপড়া করছে। সেই খরচ জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাঁকে। স্ত্রী মালবিকা বাড়িতেই আর্টস্কুল খুলেছেন। সেই স্কুলে শ্যামলবাবু ভবিষৎকে দেখতে পান। বলেন,“ওরাই আমার সব। ওদের মধ্যে যদি এই প্রথাটা ছড়িয়ে দিতে পারি তবেই সার্থক হবে ওই মাধ্যমের শিল্প।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.