গৌতম ব্রহ্ম: ছ’ বছরের মেয়ের হার্ট ফেলিওর! ডাক্তারবাবুর চোখ কপালে। মেয়ের যে প্লেটলেটও নামছে! গায়ে ভর্তি র্যাশ। ঠিক যেন সিগারেটের ছ্যাঁকা! ও একা নয়। মেনিনজাইটিসের উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি সাত বছরের একটি মেয়ের গায়েও একই রকম র্যাশ। কেউ যেন জ্বলন্ত সিগারেট ঠুসে ধরেছিল নরম চামড়ার উপর। গোল গোল, চাকা চাকা, গাঢ় বাদামি ফোস্কার মতো। আর তারও প্লেটলেট কাউন্ট নিম্নমুখী।
[প্লাস্টিক সার্জারিতে নতুন যোনিদ্বার, চিকিৎসায় বিপ্লব]
প্লেটলেট কমে যাওয়ার উপসর্গ থাকলেও এগুলো কিন্তু কোনওটাই ডেঙ্গু নয়। এ হল ‘স্ক্রাব টাইফাস।’ রাজ্য জুড়ে যে রোগ এখন ডালপালা মেলছে। শুধু পার্ক সার্কাসের ইনস্টিটিউট অফ চাইল্ড হেলথ (আইসিএইচ)-এ গত দু’মাসে ‘স্ক্রাব টাইফাস’ আক্রান্ত প্রায় ৫০টি শিশু ভর্তি হয়েছে। তিনজনকে আইসিইউয়ে রেখে চিকিৎসা করতে হয়েছে বলে জানিয়েছেন আইসিএইচ-এর ক্রিটিক্যাল কেয়ার বিশেষজ্ঞ ডা. প্রভাসপ্রসূন গিরি। শুক্রবার তিনি বলেন, “জুনের মাঝামাঝি থেকে স্ক্রাব টাইফাসের নানা রোগী পাচ্ছি। বয়স দেড় থেকে দশ বছর। হার্ট ফেলিওর, মেনিনজাইটিস, এনসেফেলাইটিস, মাল্টি অর্গান ফেলিওরের মতো উপসর্গ নিয়েও রোগী আসছে।” এবং ডাক্তারবাবুরা জানাচ্ছেন, এদের প্রত্যেকেরই প্লেটলেট কমেছে হুড়মুড়িয়ে। তাই প্রথমে ডেঙ্গু বা এনসেফেলাইটিস বলে ভুল হওয়াটা স্বাভাবিক। সেই ভুল দেরিতে ভাঙলে কিন্তু সমূহ বিপদ। প্রাণহানিও হতে পারে। এলাইজা পরীক্ষায় রোগটি ধরা পড়ে। তাই এ ধরনের কেস পেলে যত শীঘ্র সম্ভব স্ক্র্যাব টাইফাস নির্ণায়ক পরীক্ষা করিয়ে নেওয়ার উপর জোর দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। কলকাতায় স্ক্র্যাব টাইফাস প্রথমে নজরে আসে দু’বছর আগে। অজানা জ্বরের ময়নাতদন্ত করতে গিয়ে জানা যায়, অনেক জ্বরের নেপথ্যে রয়েছে এক ধরনের জীবাণু, যার বাহক মশা নয়। এক ধরনের মাকড়ের (মাইট) লার্ভা। এই মাকড় দংশন করলে শরীরে রিকেটশিয়া সুসুগামুসা নামে এক ধরনের জীবাণু অনুপ্রবেশ করে।
যা বংশবিস্তার করে বিকল করতে থাকে লিভার, হার্ট, কিডনি-সহ একাধিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। মাকড়ের বাস বনে-বাদাড়ে, ঘাসে-ঝোপ-ঝাড়ে। উড়তে পারে না। তবে দু’ থেকে আড়াই ফুট পর্যন্ত লাফাতে পারে। কামড়ালে গায়ে সিগারেটের পোড়া দাগের মতো র্যাশ বের হয়। এই মাইট-বাহিত রোগ নিয়ে সতর্ক করেছেন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. শ্যামাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়। জানিয়েছেন, স্ক্র্যাব টাইফাস এক ধরনের ‘রিকেটশিয়াল ফিভার’। এতে গায়ে ব্যথা হয়। র্যাশ বেরয়। কিডনি, লিভার-সহ একাধিক অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জঙ্গলে হাঁটলে বা ঘাসের উপর ‘মর্নিং ওয়াক’ করলেও রিকেটশিয়ার আঁচড়-কামড় খেতে হতে পারে। তাই, জুতোর সঙ্গে সঙ্গে পা ঢাকা ফুল প্যান্ট পরা জরুরি। উত্তরবঙ্গের পাহাড়ি অঞ্চলে, জঙ্গলে, দিঘা, মন্দারমণির মতো সামুদ্রিক অঞ্চলে বর্ষাকালে এই ‘মাইট’-এর উপদ্রব বাড়ে। রোগের দাওয়াই কী? শ্যামাশিসবাবু জানালেন, “স্ক্র্যাব টাইফাস ছোঁয়াচে নয়। অ্যান্টিবায়োটিকে সেরে যায়। কিন্তু সময়মতো ধরা পড়তে হবে। না হলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।” বাচ্চা-বুড়ো সবাই আক্রান্ত হতে পারেন। এ ব্যাপারে সতর্ক করেছেন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. অরিন্দম বিশ্বাসও। তাঁরও অধীনে স্ক্র্যাব টাইফাস আক্রান্ত রোগী চিকিৎসাধীন। তিনি জানিয়েছেন, অজানা জ্বরে মৃত্যু হওয়া অনেক রোগীই আসলে এই রোগের শিকার। সময়মতো চিকিৎসা না হওয়াতে জটিলতা তৈরি হয়। মাল্টি অর্গান ফেলিওর হয়। তবে আশার কথা। এখন ডাক্তাররা এই রোগ নিয়ে অনেক বেশি সতর্ক। সতর্ক পুরসভাগুলিও। গত বছর উত্তরবঙ্গে সতেরোজন রোগীর দেহে এই জ্বরের জীবাণু মিলেছে। এ বছর দক্ষিণবঙ্গে প্রকোপ বেশি। তবে, এখনও পর্যন্ত প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.