কুণাল ঘোষ: ‘পদ্মভূষণ’ প্রত্যাখ্যানের প্রশ্নে সিপিএমের তরফে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর (Buddhadeb Bhattacharya) নামে যে তিন লাইনের বিবৃতিটি প্রচারিত হয়েছিল, তাতে কি স্বয়ং বুদ্ধবাবু এবং মীরা ভট্টাচার্য একটু ক্ষুব্ধ? নির্ভরযোগ্য সূত্রে খবর তেমনই। তাঁরা মনে করছেন ওই বিবৃতির দু’টি লাইনের জন্য বুদ্ধবাবুকে অনভিপ্রেত বিতর্কে জড়িয়ে পড়তে হয়েছে। সূত্র বলছে, প্রত্যাখ্যানের সিদ্ধান্ত জানানো বাক্যটি ঠিক ছিল। কিন্তু আমি কিছু জানতাম না, আমাকে কেউ কিছু বলেনি-এই লাইন দু’টি বুদ্ধবাবুর মুখে বসানোটা ঠিক হয়নি। যেহেতু বিকেল তিনটের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক থেকে ফোন এসেছিল, তাই এই লাইন দু’টি অকারণে বুদ্ধবাবুকে কিছু প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। অথচ যেহেতু সিপিএমের তরফ থেকে তাঁর নামে এই বয়ান গিয়েছে, তাই প্রকাশ্যে তিনি কিছু বলতেও পারছেন না। শুধু প্রত্যাখ্যানের বিষয়টি এক লাইনের বিবৃতিতে থাকলেই খুশি হতেন বুদ্ধবাবু এবং মীরাদেবী।
পরিস্থিতি সামলাতে শুক্রবার আবার ‘গণশক্তি’ বুদ্ধবাবুর নামে একটি বিবৃতি দিয়ে বলেছে- “আগে জানানো হয়েছে কি হয়নি সেটা বিষয় নয়। আমাকে আগে জানানো হলেও আমি এই পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করতাম।” এতে অবশ্য ফোন এসেছিল কি না সেই বিতর্ক এড়ানো হয়েছে।
এই সূত্রটির বক্তব্য, দিল্লির বিজেপি সরকারের দেওয়া ‘পদ্মভূষণ’ বুদ্ধবাবু নিতেন না। যেখানে বাবরি ধ্বংসের নায়ক কল্যাণ সিংও একই সঙ্গে পদ্মসম্মানে, এবং আরও কিছু নীতিগত অবস্থান, তাতে বুদ্ধবাবুকে প্রত্যাখ্যান করতে হতই। এই সম্মান নিলে তাঁকে এবং পার্টিকে বড়সড় অস্বস্তিতে পড়তে হত। সমস্যাটা হয় ফোন নিয়ে। দিল্লির ফোন আসে বিকেল তিনটে নাগাদ। মীরাদেবী সাধারণ সৌজন্যে জবাব দেন। এরপর পদ্মভূষণ তালিকায় বুদ্ধবাবুর নাম থাকাতেই বিতর্ক হয়। কারণ, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ফোনে না বলে দেওয়াতেই ঘোষিত তালিকায় তাঁর নাম ছিল না।
বুদ্ধবাবুর ক্ষেত্রে ওই ফোনেই কোনও ভুল বোঝাবুঝি হয়। পরে রাতে সিপিএমের তরফে বুদ্ধবাবুর সেদিনের বিবৃতির দু’টি লাইনে জল্পনার অবকাশ তৈরি হয়। সিপিএম এখন সেটা মেরামতির চেষ্টা করছে।
প্রসঙ্গত, এই বিষয়ে আমার আগের দিনের প্রতিবেদনের পর কিছু কৌতূহলী প্রশ্ন পেয়েছি যে কেন আমি বুদ্ধবাবুর সমালোচনা করলাম? জবাবে বলি, আমি বুদ্ধবাবুকে শ্রদ্ধা করি। সাংবাদিক হিসাবেও আমি তাঁর যথেষ্ট সহযোগিতা পেয়েছি, বারবার একান্ত সাক্ষাৎকার বা বাইরে সফরসঙ্গী প্রতিবেদক হওয়ায়। বুদ্ধবাবুর সঙ্গে আমার দূরত্ব রাজনৈতিক অবস্থানগত।
আমার এখনও স্পষ্ট বিশ্লেষণ, বুদ্ধবাবুকে দিল্লির ‘পদ্মভূষণ’ স্বাভাবিক নয়। এতে রাজনীতির অঙ্ক আছে। কারণ, আমরা বুদ্ধবাবুকে সম্মান করি কি না, সেটা বড় কথা নয়। মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তাঁর এমন কোনও অবদান নেই যাতে পদ্মভূষণ পেতে পারেন। বুদ্ধবাবু আপাদমস্তক বাঙালি, রুচিশীল, সৎ, কিছু বিষয়ে সদিচ্ছা দেখিয়েছিলেন। কিন্তু তার সঙ্গে পদ্ম সম্মানের কী সম্পর্ক? বরং, উলটোদিকে, বুদ্ধবাবুর জেদের কারণে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামে বাস্তবমুখী নীতির বদলে জোর করে কৃষিজমি দখল করতে গিয়ে সর্বনাশ হয়েছে। যার প্রতিবাদ তৃণমূল করেছিল, বিজেপিও এতকাল মুখে সমালোচনা করত। তাঁর ‘আমরা-ওরা’ সংলাপে শাসকের ঔদ্ধত্য প্রকাশ পেয়েছে।
‘দে হ্যাভ বিন পেইড ব্যাক বাই দেয়ার ওন কয়েনস’ মন্তব্যে রাজনৈতিক সন্ত্রাসে সমর্থন প্রকাশ পেয়েছে। ফলত তাঁর সরকার শুধু নয়, তিনি নিজেও পরাজিত হয়েছেন। বুদ্ধবাবু অবশ্যই লেখক। মায়াকভস্কির অনুবাদ থেকে শুরু করে নাটক, অন্যান্য কিছুও লিখেছেন। কিন্তু সেগুলি কি পদ্ম- সম্মান পর্যায়ের?
তাহলে পদ্মভূষণ কেন? কারণ, রাজনীতি। বিজেপির ভোটব্যাংক বাম ভোটে পরিপুষ্ট ছিল এটা প্রমাণিত। তাতে ভাটার টান। বামপন্থীদের কাছে দিল্লির রামপন্থীদের বন্ধুত্বের বার্তা – তোমাদের নেতাকে পদ্মভূষণ দিচ্ছি। তোমরা আমাদের ভোট দাও। বুদ্ধবাবু নিন বা না নিন, এই বার্তাটাই এবারের এই নাম ঘোষণার তাৎপর্য। বুদ্ধবাবুকে আডবানী পছন্দ করতেন। এখন বিজেপি তাঁকে বাম ভোটব্যাংকের যেটুকু আর পড়ে আছে তার অন্যতম মুখ বলে মনে করছে। রাজনৈতিক মহল মূলত এই অঙ্কটিকেই বুদ্ধবাবুর নাম নির্বাচনের কারণ বলে মনে করছে।
সমস্যা হল বিশ্লেষণ সামনে এলেই সিপিএম সমর্থকরা রে রে করে ওঠেন। পদ্মসম্মান নিয়ে পর্যালোচনার ক্ষেত্রে বুদ্ধবাবুকে অসম্মানের যে কোনও প্রশ্ন নেই, এই বাস্তবটা কমরেডদের একাংশ মানতে চান না। আবার বলছি বুদ্ধবাবু এমন কিছু করেননি যাতে তিনি পদ্মভূষণ পেতে পারেন। কিন্তু তার সঙ্গে এটাও বলব, এই বিশ্লেষণে বুদ্ধবাবুর নিজস্ব গুণ বা বৈশিষ্ট্যগুলি কোথাও ছোট হচ্ছে না। শ্রদ্ধেয় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, আপনি আমার প্রণাম নেবেন। ভাল থাকুন। সুস্থ থাকুন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.