কৃষ্ণকুমার দাস: প্রতিহিংসার জেরে আর জি কর মেডিক্যালের সাসপেন্ড ও বহিষ্কার ৫৩ জুনিয়র ডাক্তারদের বিরুদ্ধে প্রিন্সিপ্যাল ও মেডিক্যাল সুপার চরম পক্ষপাতিত্ব ও বৈষম্যমূলক একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে নথি জমা পড়ল স্বাস্থ্যভবনে। চাঞ্চল্যকর তথ্য হল, আরডিএ নামে অনিকেত মাহাতোদের যে সংগঠনের অভিযোগের ভিত্তিতে ওই ৫৩ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি সিদ্ধান্ত নিল, তার ন্যূনতম স্বীকৃতির চারদিন আগেই ওই জুনিয়র ডাক্তারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন আর জি কর-এর দুই শীর্ষকর্তা। স্বাস্থ্যভবনের নথি বলছে, গত ৯ সেপ্টেম্বর প্রিন্সিপ্যাল ও মেডিক্যাল সুপার (এমএসভিপি) সই করে রেসিডেন্ট ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন (আরডিএ)-কে স্বীকৃতি পায় অর্থাৎ স্বাস্থ্য প্রশাসনের কাছে জন্ম নেয় সংস্থাটি।
অবশ্য জন্মের আগেই গত ৫ সেপ্টেম্বর এই আরডিএ-র সুপারিশেই ৯ সেপ্টেম্বর সকাল থেকেই আর জি করে এই ৫৩ জনের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন প্রিন্সিপ্যাল মানস বন্দ্যোপাধ্যায় ও মেডিক্যাল সুপার সপ্তর্ষি চট্টোপাধ্যায়।
আর প্রশ্ন এখানেই, কোন অদৃশ্য ক্ষমতার দাপটে জন্মের আগে এতটা ক্ষমতার অধিকারী হয়ে এই জুনিয়র ডাক্তারদের হাসপাতালে ঢোকা বন্ধ করে দিল আরডিএ। উল্লেখ, এই আরডিএ-র সভাপতি অনিকেত মাহাতো এবং সম্পাদক আসফাকুল্লা নাইয়া। সাসপেন্ডেড ডাক্তারদের অভিযোগ, “প্রিন্সিপ্যাল ও সুপার এবং তদন্ত কমিটির দুই প্রভাবশালী সদস্য সরাসরি আরডিএর নেতাদের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে একতরফাভাবে প্রমাণ ছাড়াই অভিযুক্তদের বক্তব্য না শুনেই কড়া ব্যবস্থা নিয়েছেন। আর জি করকে আরডিএ নেতাদের অবাধ মৌরসিপাট্টার ব্যবস্থা করে দিতে অনিকেত-আসফাকুল্লাদের হাতের পুতুল হয়ে গিয়েছেন সুপার ও প্রিন্সিপ্যাল।”
একতরফা সিদ্ধান্তে এই ৫৩ জনের মধ্যে ১০জনকে বহিষ্কার করার জেরে পাঁচবছর ধরে এমবিবিএস কোর্স সম্পূর্ণ করার পর কার্যত সকলেই দ্বাদশ শ্রেণি উত্তীর্ণ ছাত্রছাত্রীতে রূপান্তরিত হয়েছেন। বস্তুত এই কারণেই সোমবার নবান্নর বৈঠকে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেছিলেন, “যথেষ্ট তথ্য ও প্রমাণ না নিয়ে এবং উভয় পক্ষের বক্তব্য না শুনে কড়া ব্যবস্থা নিয়ে কারও কেরিয়ার শেষ করে দেওয়া যায় না।”
এটা কি পালটা থ্রেট কালচারের প্রকৃষ্ট উদাহরণ নয়? কী বলবেন আরডিএ নেতারা? সাসপেনশন যে বেআইনি, তা স্থগিতাদেশ দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে কলকাতা হাই কোর্ট, এখন দেখার এমন একতরফা সিদ্ধান্ত কাদের চাপে নিতে বাধ্য হলেন প্রিন্সিপ্যাল ও সুপার।
‘থ্রেট কালচার’ নিয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি ও কলেজ কাউন্সিল নাকি শুনানি করে ৫৩ জনকে সাসপেন্ড ও বহিষ্কার করেছে বলে আরডিএ দাবি করেছে। কিন্তু বাস্তব কী?
তদন্ত কমিটির নামে কী কী হয়েছিল ৫ সেপ্টেম্বর থেকে আর জি কর হাসপাতালে? স্বাস্থ্যভবনে জমা পড়া নথি বলছে– ১) আরডিএ সংগঠন প্রিন্সিপ্যাল ও সুপারের সই পাওয়ার পর হাসপাতালের খাতায় জন্ম নিল ৯ সেপ্টেম্বর বিকেলে। অথচ ৫ তারিখের চিঠির ভিত্তিতেই ৯ সেপ্টেম্বর সকাল থেকে ৫৩ জনকে কেন হাসপাতালে ঢুকতে নিষেধাজ্ঞা জারি হল?
২) আরডিএ অভিযোগ জমা দেওয়ার আগে ৫ সেপ্টেম্বর অ্যানাটমি লেকচার হলে একটি সাধারণ সভা (জিবি) ডাকা হয়। সেই সভায় সাদা কাগজে সবাই হাজির বলে সই করেই পরে সেই স্বাক্ষরের তালিকা জুড়ে দিয়ে ৫৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগকারী হিসাবে দাবি করা হয়। এমন একজন রয়েছেন, যাঁর নাম অভিযোগকারী ও অভিযুক্ত, দুই তালিকাতেই ছিল কেন? এই জিবিকে ক্যাঙারু কোর্ট কেন বলা হবে না?
৩) তদন্ত কমিটির কাছে অভিযোগ জানাতে বলে একটি ই-মেল দেওয়া হয়েছিল। সেখানে নির্দিষ্ট অভিযোগ লিখতে না দিয়ে কেন মাল্টিপল চয়েস ধাঁচের তালিকা দেওয়া হয়েছিল?
৪) যে ৫৩ জন জুনিয়র ডাক্তারকে তদন্ত কমিটিতে ডাকা হয়, তাঁদের বিরুদ্ধে কী কী অভিযোগ, তা কেন জানানো হল না? এমনকী আইনজীবীর তরফে ই-মেল করার পরও কেন উত্তর দিলেন না প্রিন্সিপ্যাল বা সুপার?
৫) বোর্ডরুমে শুনানির সময় সিআরপিএফ দিয়ে সন্ত্রাসবাদীদের পরীক্ষার স্টাইলে ওই ৫৩ জন জুনিয়র ডাক্তারের দুই দফায় দেহ তল্লাশি এবং ফোন ও আত্মপক্ষ সমর্থনের নথিপত্র ছাড়াই কমিটির সামনে যেতে বাধ্য করা হল কেন?
৬) অভিযুক্তদের ফোন ও নথিপত্র ছাড়াই ঢুকতে বাধ্য করা হলেও কেন সাক্ষী বা অভিযোগকারী সকলকেই ফোন ও নথি নিয়ে যেতে দেওয়া হল?
৭) সাসপেন্ড করার আগে একজনকেও কেন চার্জশিট দেওয়া হল না? আট সদস্যের এই তদন্ত কমিটি কেন কাউকে শোকজের চিঠিও দিল না?
৮) প্রশাসনের তরফে গঠিত তদন্ত কমিটির দুই সদস্য ডা. দেবব্রত দাস ও ডা. নীলাঞ্জন ঘোষ গণস্বাক্ষর করে ইস্তফা দেওয়ার পরও কি দুজনকে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ বলা যায়? জুনিয়র চিকিৎসকদের দাবি, এই দুজন ধর্মতলায় ধরনামঞ্চে গিয়ে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে গলা মিলিয়েছেন। তা হলে এই দুজন কি নিরপেক্ষ তদন্তকারী?
৯) কলেজ কাউন্সিলকে ঘেরাও করে সমবেত চিৎকার ও হুমকির মাধ্যমে যে একতরফা সিদ্ধান্ত পাস করানো হল তা কি আইনি স্বীকৃত?
১০) অভয়াকে নির্মমভাবে ধর্ষণ ও খুনের পর যাঁরাই ৯ আগস্টের পর প্রথম আর জি কর হাসপাতালে আন্দোলন শুরু করেছিলেন, সেই জুনিয়র ডাক্তারদেরই কেন বেছে বেছে তালিকাভুক্ত করে সাসপেন্ড করা হল?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.