ফাইল ছবি।
স্টাফ রিপোর্টার: আর জি কর কাণ্ডে রীতিমতো নাটকীয় পর্দাফাঁস! মৃতা তরুণী চিকিৎসকের ময়নাতদন্তে ‘ব্যাপক বেনিয়মের’ অভিযোগ তুলে লাগাতার আন্দোলনে সরব হওয়া জুনিয়র ডাক্তাররাই এবার কাঠগড়ায়। এমনকী ঘটনাস্থল তথা চেস্ট মেডিসিন বিভাগের সেমিনার রুম লাগোয়া যে দেওয়াল ভাঙা নিয়ে ওই ডাক্তারবাবুরা তথ্যপ্রমাণ লোপাটের তত্ত্ব খাড়া করতে মরিয়া, সেই ঘটনার দায়ও কার্যত চাপছে তাদের ঘাড়েই! আর জি করের ভয়ংকর ঘটনায় মৃতার ময়নাতদন্তে নানা তথাকথিত অসঙ্গতির তত্ত্ব মেলে ধরে নেপথ্যে ষড়যন্ত্রের ন্যারেটিভ পোক্ত করতে জুনিয়র ডাক্তারবাবুরা এখনও আন্দোলনে অনড়। অথচ কী আশ্চর্য, ঘটনার দিন মৃতার ময়নাতদন্ত অন্য হাসপাতালে করার দাবি কিন্তু সেই জুনিয়র ডাক্তাররা একবারও তোলেননি! বরং তৎকালীন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে রীতিমতো চিঠি দিয়ে যে চার দফা শর্ত তারা দিয়েছিলেন, হুবহু সেই শর্তাবলী মেনেই হয়েছিল ময়নাতদন্ত। এবং ময়নাতদন্ত চলাকালীন দুজন জুনিয়র ডাক্তার সেখানে হাজিরও ছিলেন। যেসব তথ্যের ভিত্তিতে ছানবিন চালাচ্ছেন সিবিআইয়ের তদন্তকারীরা, সেই নথির ভিত্তিতেই ফাঁস চাঞ্চল্যকর এই তথ্য। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে, নিজেদের দেওয়া শর্ত অনুযায়ী এবং নিজস্ব প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতেই হওয়া ময়নাতদন্ত নিয়ে জুনিয়র ডাক্তারদের তথাকথিত অসঙ্গতির তত্ত্ব কোনও অলীক কুনাট্যের অঙ্গ নয় তো?
সেমিনার রুম লাগোয়া দেওয়াল ভাঙার নেপথ্যে তথ্যপ্রমাণ লোপাটের চক্রান্তের অভিযোগেও সরব ডাক্তারবাবুরা। অথচ এক্ষেত্রেও তাদের দ্বিচারিতা এককথায় বেনজির। ঘটনার দিন অর্থাৎ ৯ আগস্টই আর জি কর হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসকদের বিশ্রামকক্ষ, শৌচাগার তৈরির দাবি তুলে সরব হয়েছিলেন জুনিয়র ডাক্তাররা। সেই কাজ করতেই গত ১০ ও ১২ আগস্ট দু’দফায় সরেজমিনে পরিদর্শনের পর সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ঘর ভাঙা বা ভোলবদলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেই পরিদর্শন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণপর্বেও শামিল হয়েছিলেন জুনিয়র ডাক্তাররা। শুধু তাই নয়, যে বৈঠকে সর্বসন্মত ওই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তার কার্যবিবরণীতে বাস্তুকার, কর্তব্যরত নার্সরা ছাড়াও জ্বলজ্বল করছে তিন জুনিয়র ডাক্তারের স্বাক্ষর। সিবিআই তদন্তে আতশকাচের নিচে থাকা একাধিক নথির অনুলিপি-সহ সোশাল মিডিয়ায় সাংবাদিক সঞ্জয় ভদ্রর করা একের পর এক পোস্টে আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারদের এই দ্বিচারিতা ফাঁস হয়েছে। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে, জুনিয়র ডাক্তারবাবুদের এই আন্দোলন কি প্রকৃতই ন্যায়বিচারের লক্ষ্যে? না কি গণআবেগকে হাতিয়ার করে স্রেফ রাজ্য সরকারের ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত করার অপপ্রয়াস?
গত ৯ আগস্ট সকালে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চেস্ট মেডিসিন বিভাগের সেমিনার রুম থেকে তরুণী চিকিৎসকের দেহ উদ্ধার হয়। ধর্ষণের পর তাঁকে খুন করা হয় বলে অভিযোগ। পাঁচ দফা শর্ত বেঁধে দিয়ে ওই চিকিৎসকের দেহ ময়নাতদন্ত করার জন্য আর জি করের তৎকালীন অধ্যক্ষের কাছে আবেদন জমা দেওয়া হয়। সেই আবেদনে মৃতার বাবার স্বাক্ষর যেমন রয়েছে, তেমনই স্বাক্ষর রয়েছে দুই জুনিয়র ডাক্তারবাবুরও। তারাই ওই শর্ত ঠিক করে দেন বলে সূত্রের খবর। পাঁচটির মধ্যে প্রথম শর্তই ছিল আরজিকর হাসপাতালেই ময়নাতদন্ত করতে হবে। এছাড়া জুনিয়র ডাক্তারদের দাবি মেনে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের তদারকিতে, সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ার ভিডিওগ্রাফি-সহ মহিলা বিশেষজ্ঞদের উপস্থিতিতেই গোটা ময়নাতদন্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। সর্বোপরি ওই আবেদনপত্রের শেষ শর্ত অনুযায়ী, ময়নাতদন্ত চলাকালীন চারজন জু্নিয়র ডাক্তার সেখানে ছিলেন। কাজেই প্রশ্ন উঠছে, চার-চারজন জুনিয়র ডাক্তার যে প্রক্রিয়ার সাক্ষী, সেই ময়নাতদন্তে অসঙ্গতির অভিযোগ সেই জুনিয়র ডাক্তাররাই তোলেন কীভাবে? সেক্ষেত্রে কোনও বেনিয়ম হয়ে থাকলে তার দায় ওই জুনিয়র ডাক্তারদের উপরও সমানভাবে বর্তায় না কি? সংশ্লিষ্ট মহলের একাংশের আরও প্রশ্ন, ষড়যন্ত্রের ন্যারেটিভ সাজাতেই সব জেনেশুনে জুনিয়র ডাক্তারদের তরফে ময়নাতদন্তে অসঙ্গতির অসার তত্ত্ব খাড়া করা হচ্ছে না তো?
ঘটনাস্থল অর্থাৎ সেমিনার রুমের সংলগ্ন দেওয়াল ভাঙার নেপথ্যে এখন তথ্যপ্রমাণ লোপাটের ভয়াবহ চক্রান্ত খুঁজে পাচ্ছেন জুনিয়র ডাক্তাররা। এই বিষয়টিকে হাতিয়ার করেই তারা স্বাস্থ্যভবন অভিযান, টানা অবস্থান থেকে শুরু করে এমনকী স্বাস্থ্যভবন সাফাইয়ের ডাক পর্যন্ত দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তব হল, জুনিয়র ডাক্তারদের দাবিমতো বিশ্রামঘর, শৌচাগার তৈরির লক্ষ্যেই বিভিন্ন ঘর ভেঙে নতুন করে নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। আর সেই প্রক্রিয়াতেও ওতপ্রোতভাবে জডিয়ে ছিলেন জুনিয়র ডাক্তাররা। নয়া ওই নির্মাণ কীভাবে হবে তা নিয়ে গত ১০ ও ১২ আগস্ট দু’দফায় হাসাপাতালের সংশ্লিষ্ট এলাকা পরিদর্শন করে বাস্তুকার, চিকিৎসক ও নার্সদের একটি দল। জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিনিধি সেই দলে ছিলেন। সেই পরিদর্শনের ভিত্তিতেই গত ১২ আগস্ট বৈঠকে কয়েকটি ঘরের একাংশ ভেঙে বা ভোলবদল করে কর্মরত চিকিৎসকদের বিশ্রামঘর, নার্সদের পোশাক পরিবর্তন কক্ষ, আরএমও ও জিডিএদের নির্দিষ্ট কক্ষ প্রভৃতি তৈরির পাঁচদফা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
চেস্ট মেডিসিন বিভাগে ওই নির্মাণ সংক্রান্ত বৈঠকের গৃহীত সিদ্ধান্তের কার্যবিবরণীতে বিভাগীয় প্রধান, সংশ্লিষ্ট বাস্তুকার, তিন জন নার্স ছাড়াও তিনজন পিজিটির স্বাক্ষর রয়েছে। জানা গিয়েছে, ওই সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই সেমিনার রুম লাগোয়া ঘরের দেওয়াল ভাঙার কাজ শুরু হয়েছিল। আর সেই কাজ শুরুর কথাও জুনিয়র ডাক্তাররা বিলক্ষণ জানতেন। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, তথ্যপ্রমাণ লোপাটের অভিযোগ দাঁড় করানোর জন্যই কি তাহলে সেই ডাক্তারবাবুরা এখন স্রেফ ভাবের ঘরে চুরি করছেন? নাকি নারকীয় এই ঘটনা ও পরে উঠে আসা বিভিন্ন অভিযোগের সঙ্গে নিজেদের ছোঁয়াচ এড়াতেই এখন আন্দোলনের আড়াল খুঁজছেন বিদ্রোহের ধ্বজাধারী ‘বিপ্লবী’ জুনিয়র ডাক্তাররা?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.