বিশেষ সংবাদদাতা: তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে কি ভোট পরামর্শদাতা সংস্থা আই-প্যাকের বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছে? এনিয়ে রাজ্য রাজনীতিতে জল্পনা তুঙ্গে। তৃণমূলের অন্দরমহলেও চর্চা অব্যাহত। সর্বশেষ পরিস্থিতি হল, আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও বিচ্ছেদ সম্পূর্ণ হয়নি। তবে ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোরের উপর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee) আপাতত এতটাই রুষ্ট যে দূরত্ব চরমে। এখন দলীয় কাজকর্ম সাংগঠনিক নেতাদের দিয়েই করাতে চাইছেন তিনি।
আই-প্যাকের কর্মপদ্ধতি নিয়ে দলে দু’রকমই মতামত আছে। তবে ২০১৯-এ লোকসভার ধাক্কার পর ঘুরে দাঁড়ানোর প্রশ্নে আই-প্যাকের বেশ কিছু সাংগঠনিক দাওয়াই যে বিশেষ কার্যকর হয়েছিল, তা দলের অনেকেই মানেন। সমস্যা হল, নেত্রীর কাছে অভিযোগ পৌঁছেছে যে আই-প্যাক কিছু ক্ষেত্রে তাদের কাজের গণ্ডির সীমা লঙ্ঘন করছে। তাদের শীর্ষকর্তারা নেত্রী এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় (Abhishek Banerjee) ছাড়া কাউকে মানছেন না। এতে পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং সুব্রত বক্সিরা (Subrata Baksi) অপমানিত বোধ করেছেন। তাঁরা বিষয়টি নেত্রীর নজরে এনেছেন তো বটেই, সেই সঙ্গে প্রয়োজনে রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানোর কথা বলেছেন। ফলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিব্রত হয়েছেন। পুরভোটের তালিকা নিয়ে জটিলতা আরেকটু বেড়েছে। পিকে মমতাকে বাংলা, ত্রিপুরা, মেঘালয়ে কাজ না করার বার্তা পাঠান। ক্রুদ্ধ নেত্রী ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ লিখে দেন। তারপর থেকে আর পিকে’র (Prashant Kishor) সঙ্গে তাঁর কথা হয়নি। নেত্রীর ঘনিষ্ঠমহলের অভিযোগ, নেত্রী ও অভিষেক আই-প্যাককে যথেষ্ট স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। তারপর তারা ভোটের পরেও দলের ভিতরের বিষয়ে ঢুকে আসছে। এটা পার্থ, বক্সি-সহ সিনিয়র কয়েকজন আপত্তি জানান। এমনকী, পার্থর বেহালাতেও সংগঠন নিয়ে আইপ্যাকের সক্রিয়তা তিনি পছন্দ করেননি।
আবার উলটোদিকে অন্য শিবিরের বক্তব্য, বাংলার বেশ কিছু অঞ্চলে তৃণমূলের স্থানীয় স্তরে যে অভ্যন্তরীণ ক্ষয় চলছিল, তা আই-প্যাকের টিমের রণকৌশল ও পরিশ্রম দিয়েই মেরামত হয়েছে। নেত্রীর জনপ্রিয়তা ও সামাজিক স্কিমগুলি সত্ত্বেও বেশ কিছু আসন স্রেফ সাংগঠনিক কারণে পর্যুদস্ত ছিল। সে সব সামলানো গিয়েছে। ‘দিদিকে বলো’ থেকে ‘বাংলার গর্ব মমতা’, বিভিন্ন কর্মসূচিতে দলকে আবার সক্রিয় করা গিয়েছে। সংগঠিতভাবে বহু কাজ হয়েছে। ২০২১ বিধানসভা জয়ের পথে তাদের ভূমিকাও তাৎপর্যপূর্ণ।
এই পরস্পরবিরোধী মতামত চলছিলই। এখন, বিধানসভায় তৃণমূলের বিপুল জয়ের পর বিভিন্ন কারণে দূরত্ব বাড়তে থাকে। অভিষেক এই আই-প্যাক (I-Pac) টিমের সঙ্গে মানিয়ে নিলেও মূলত একাংশের কিছু সিনিয়রের সঙ্গে তাদের মিলমিশ হয়নি। বহু ক্ষেত্রেই সুপরিচিত নেতাদের এলাকায় আই-প্যাকের তরুণ ছেলেমেয়েদের গতিবিধি, সমীক্ষা ও পরামর্শ থেকে ইগোর লড়াই হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে আই প্যাকের কোনও কোনও সদস্য এলাকাভিত্তিতে পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়েছেন। এই গোটা বিষয়টা নিয়ে পার্থ, বক্সি-সহ কয়েকজন হেস্তনেস্তর মেজাজে চলে গেলে নেত্রী টালবাহানার মধ্যে পড়েন। জটিলতা ডালপালা মেলতে থাকে। দু’-তিনজন পুরনো সিনিয়র নেত্রীকে বলেন, তাঁরা রাজনীতি করবেন না।
অন্যদিকে, অভিষেকের ভাবনা হল, মানুষ সময়োপযোগী কর্মসূচির জন্য তৃণমূলের পক্ষে রায় দিয়েছেন। মাথার উপর জননেত্রী থাকবেন পূর্ণ মহিমায়। কিন্তু তারপর দলে কিছু কৌশলগত রদবদল জরুরি। অভিষেকের আশঙ্কা, ২০২৪-এর ভোট লোকসভার। সেখানে মোদি ও বিজেপির পক্ষে কিছু বাড়তি ভোট সুইং হতেই পারে। কারণ জাতীয় রাজনীতি বিকল্প দিতে কংগ্রেস ব্যর্থ। বিজেপি কিছু আসন পেয়ে গেলে আবার তাদের মনোবল বাড়বে। ফলে ২০২১ জয়ের সাংগঠনিক মডেল আরও সময়োপযোগী করতে হবে। অন্যদিকে মমতার সমস্যা একাংশের সিনিয়রদের অনড় মনোভাব। তাঁরা আই-প্যাক ও অভিষেককে এক করে দেখছেন। নেত্রীর ঘনিষ্ঠমহল সূত্রের খবর, এর মধ্যে বিশেষ কিছু কারণে আইপ্যাক কর্তার উপর আরও ক্ষুব্ধ হয়েছেন তিনি। এমতাবস্থায় নেত্রীর এখনও পর্যন্ত সিদ্ধান্ত, আই-প্যাককে নিয়ে আর চলবেন না তিনি। অভিষেক অবশ্য পিকের সঙ্গে কথা বলছেন। বিষয়টি জটিলতম জায়গায় সুতোর উপর ঝুলছে।
মধ্যপন্থী একটি মহলের বক্তব্য, আই-প্যাক যদি ভেবে থাকে যে শুধু তারাই জিতিয়েছে, তাহলে সেটা ভুল। কারণ জননেত্রীর ইমেজ, কিছু সামাজিক স্কিম, অভিষেকের লড়াই আর তখন গদ্দারদের বিরুদ্ধে তৃণমূলকর্মীদের জেদ, এসবও বিরাট ফ্যাক্টর ছিল। সেই সঙ্গে ছিল বঙ্গঅস্মিতা। বিজেপির ‘বহিরাগত’ নেতাদের কথা মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। আবার এটাও ঠিক যে ২০১৯-এর পর তৃণমূল যখন চাপে, তখন বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতিতে বুথস্তর পর্যন্ত দলটিকে চাঙ্গা করার ক্ষেত্রেও বিকল্প জনসংযোগের প্রশ্নে আই-প্যাকের দারুণ কার্যকর ভূমিকা ছিল। কিন্তু সমস্যা হল, ভোটের আগে যে সমস্যাগুলি সামনে বেশি আসেনি, এখন বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ নিশ্চিন্ত তৃণমূলে সেগুলি প্রকট। আই-প্যাক বনাম কিছু সিনিয়র, এই মেরুকরণ দল ও নেত্রীকে বিড়ম্বনায় ফেলছে। সূত্রের খবর, নেত্রীর কাছে পার্থবাবু এমন অভিযোগও করেছেন যে, তিনি পুরভোটের প্রার্থীতালিকা চাইলে পিকে তাঁকে দিতে চাননি। এতে তিনি যারপরনাই অপমানিত বোধ করে সরে দাঁড়াতে চেয়েছেন। শেষপর্যন্ত নেত্রী হস্তক্ষেপ করে পুরভোট পার্থ-বক্সির হাতে রাখতেই সবুজ সংকেত দিয়েছেন। সরকারের দশরকম কাজের ফাঁকে এই অভ্যন্তরীণ ঝামেলায় দারুণ ক্ষুব্ধ নেত্রী। অন্যদিকে অভিষেকের আক্ষেপ, এতবড় জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসেও ভবিষ্যৎমুখী ভাবনাগুলো হোঁচট খাচ্ছে। নেত্রী এই জটিলতা সামলাতে নিজে অনেকটা সময় দিচ্ছেন। পার্থ, বক্সির দায়িত্ব বাড়িয়েছেন। আর ২০২১ বিধানসভার আগের তীব্র লড়াইয়ের সময়টা মনে করে একটু সরে থাকছেন অভিমানাহত অভিষেক।
এই সুতোর উপর ঝুলছে তৃণমূল এবং আইপ্যাকের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ। এখন যা অবস্থা, শেষ মুহূর্তে অবস্থা না বদলালে আনুষ্ঠানিক বিচ্ছেদ যেন শুধু সময়ের অপেক্ষা। সম্পর্কটা এখন অতিসংকটজনক অবস্থায় ভেন্টিলেশনে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.