স্টাফ রিপোর্টার: ময়নাতদন্ত চলাকালীন তাঁদের পাঁচ প্রতিনিধি সেখানে ছিলেন। গোটা প্রক্রিয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করে নথিতে সইও করেন তাঁরা। তারপরই বেনজির ভোলবদল! আর জি করে মৃতা তরুণী চিকিৎসকের সেই ময়নাতদন্তেই ‘ব্যাপক বেনিয়মে’র অভিযোগে সরব জুনিয়র ডাক্তাররা! ময়নাতদন্তের ওই নথি গত শুক্রবার ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এ ফাঁস হতেই তথাকথিত ‘ন্যায়বিচারের’ দাবিতে সরব জুনিয়র ডাক্তারদের দ্বিচারিতা বেআব্রু হয়ে পড়েছিল। চাপের মুখে মঙ্গলবার শেষপর্যন্ত এই প্রসঙ্গে জুনিয়র ডাক্তারদের সাফাই তাদের দ্বিচারিতার পাশাপাশি ‘নির্লজ্জ দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণে’ও সিলমোহর দিল। জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের অন্যতম মুখ কিঞ্জল নন্দ এদিন জানিয়েছেন, ‘‘ওখানে জুনিয়র ডাক্তারদের সই থাকলেও ময়নাতদন্তের স্বচ্ছতার দায় আমাদের উপর বর্তায় না।’’ আর তাঁর এই মন্তব্য ঘিরেই তোলপাড় তুঙ্গে। প্রশ্ন উঠছে, ময়নাতদন্তে নিজেদের প্রতিনিধি হাজির থাকার কথা বেমালুম চেপে গিয়ে জুনিয়র ডাক্তাররা তবে এতদিন আন্দোলনের নামে কুৎসা ছড়াচ্ছেন কেন? কাদের উসকানিতে? সর্বোপরি যে ময়নাতদন্ত প্রক্রিয়া দেখেশুনে ততে ‘সন্তুষ্ট’ বলে জুনিয়র ডাক্তাররা নিজেরাই সই করেছেন, এখন তার স্বচ্ছতার দায় ঝেড়ে ফেলে স্রেফ পুলিশকে নিশানা করলে চলবে কেন? এই যুক্তিতেই সংশ্লিষ্ট মহল বিশেষত চিকিৎসক সমাজের একাংশেরও প্রশ্ন, ময়নাতদন্তের নথিতে সই করেও পরে রং বদলে তা নিয়েই বিভ্রান্তি ছড়ানোর অভিযোগে জুনিয়র ডাক্তারদের ওই প্রতিনিধিদের গ্রেপ্তার করা হবে না কেন? ওই জুনিয়র ডাক্তারদের সিবিআই হেফাজতে নিয়ে জেরা করার দাবি তুলেছেন তারা।
প্রসঙ্গত, গত ৯ আগস্ট নির্যাতিতার দেহ উদ্ধারের পর আরজিকরেই ময়নাতদন্ত করা সহ পাঁচদফা শর্ত আরোপ করে তৎকালীন অধ্যক্ষের কাছে আবেদন করেছিলেন জুনিয়র ডাক্তাররা। ইতিমধে্যই ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এ প্রকাশিত সেই নথিতেই স্পষ্ট যে, প্রথমে দু’জন পিজিটি বা ডাক্তারি পড়ুয়াকে ময়নাতদন্ত চলাকালীন মর্গে উপস্থিত থাকার শর্ত দেওয়া হয়। পরে ইংরেজিতে ‘টু’ শব্দটি কেটে ‘ফোর লেখা হয়। অর্থাৎ জুনিয়র ডাক্তারদের চাহিদা ছিল, চারজনকে ময়নাতদন্তের সময় উপস্থিত থাকতে দিতে হবে। কিন্তু নতুন যে নথিটি ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর হাতে এসেছে, তাতে স্পষ্ট যে, চারজনের বদলে শেষ পর্যন্ত পাঁচজন ডাক্তারি পড়ুয়া ময়নাতদন্তের সময় মর্গে হাজির ছিলেন। নথিতে আরও ধরা পড়েছে যে, মর্গে উপস্থিত ওই পাঁচ জুনিয়র ডাক্তারই ময়নাতদন্ত প্রক্রিয়ায় হাজির থেকে এবং সব দেখেশুনে সন্তুষ্ট। যে পঁাচজন পিজিটির সই রয়েছে তাঁদের মধে্য দু’জন প্রসূতি ও শিশু বিভাগ, দু’জন চেস্ট ও একজন নিউরোমেডিসিনের। সেই নথির নিচের অংশে সই করেছেন আর জি কর হাসপাতালের ফরেনসিক চিকিৎসক ডা. অপূর্ব বিশ্বাস, যাঁকে ইতিমধ্যেই একাধিকবার তলব করে জেরা করেছে সিবিআই। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, এর পরও এই জুনিয়র ডাক্তাররাই কীভাবে ময়নাতদন্ত নিয়ে প্রশ্ন তোলেন? স্রেফ ষড়যন্ত্রের ন্যারেটিভ সাজাতেই জুনিয়র ডাক্তারদের তরফে ময়নাতদন্তে অসঙ্গতির অসাড় তত্ত্ব খাড়া করা হচ্ছে কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠে যায়। নির্যাতিতা তথা ‘অভয়া’র ন্যায়বিচারই যে কমিটির রীতিমতো ঘোষিত ‘অ্যাজেন্ডা’, কলেজের সেই ‘অ্যাডভাইসরি বোর্ড’ তথা হালের পরিচালন সমিতিতেও ময়নাতদন্তে হাজির ওই জুনিয়র ডাক্তারদেরই নাম থাকায় বিতর্ক আরও দানা বাঁধে।
ঠিক এই আবহেই মঙ্গলবার নতুন করে ফের ‘পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতি’ ঘোষণার অনুষঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের মঅন্যতম মুখ কিঞ্জল নন্দ বলেন, ‘‘ময়নাতদন্ত নিয়ে সমাজমাধ্যমে কিছু বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। ওই চিকিৎসকের ময়নাতদন্ত হয়েছিল বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে। ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশের উচ্চ আধিকারিকদের উপস্থিতিতে ময়নাতদন্ত হয়। আমরা চেয়েছিলাম, কোনওভাবেই যেন ওই ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া না হয়। আমাদের স্বল্প জ্ঞানে সেই চেষ্টাই করেছিলাম। ওখানে জুনিয়র ডাক্তারদের সই থাকলেও ময়নাতদন্তের স্বচ্ছতার দায় আমাদের উপর বর্তায় না।’’ সমাজমাধ্যমে যে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে, তার তীব্র নিন্দা জানাই।’’ সমাজমাধ্যমে ‘এই বিভ্রান্তি ছড়ানোর’ প্রতিবাদে কিঞ্জল সরব হলেও এরপরই রীতিমতো পাল্টা প্রশ্নবাণের নিশান হন জুনিয়র ডাক্তাররা।
সাংবাদিক বৈঠকে ময়নাতদন্ত নিয়ে জুনিয়র ডাক্তারদের তরফে কিঞ্জলের ওই সাফাইয়ের পর বিভিন্ন মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া ছডা়য়। জুনিয়র ডাক্তারদের রীতিমতো কাঠগড়ায় তুলে প্রশ্ন ওঠে যে, প্রথমত ময়নাতদন্তের ওই নথিতে সই মানেই তো উপস্থিতি, সম্মতি এবং ঠিকঠাক কাজের মান্যতা। কিন্তু আপত্তির তো কোনও চিহ্নই নেই! আর আপত্তি থাকলে সইয়ের সঙ্গে সেটা কেন লেখা হয়নি? তখন সই করে এখন প্রতিবাদের নামে নাটক করছেন কেন? সব গোপনে হয়েছে, এমন অপপ্রচার ও কুৎসা হতে দিলেন কেন? সবচেয়ে বড় কথা, তাহলে আপনারাই আবার প্রতিবাদী, আরজিকরের কমিটিতেও এলেন! কীভাবে? বলাই বাহুল্য, ময়নাতদন্ত নিয়ে তাদের এমন দ্বিচারী অবস্থান ফাঁস হওয়ার পর একের পর উড়ে এলেও সেসবের উত্তর দেওয়ার সৌজন্য আর দেখাননি জুনিয়র ডাক্তাররা। বরং তারা সাধারণ রোগীদের থোড়াই কেয়ার করে টানা কর্মবিরতির যৌক্তিকতা প্রমাণ করতেই ব্যস্ত!
এদিকে লালবাজারের সূত্রে খবর, ঘটনার দিন অর্থাৎ ৯ আগস্ট কলকাতার তৎকালীন পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েল আরজিকর হাসপাতালে গিয়ে বলেছিলেন যে, তাঁরা ময়নাতদন্তের রিপোর্টের ব্যাপারে স্বচ্ছতা চান। তাই আন্দোলনরত চিকিৎসক ও জুনিয়র ডাক্তাররা চাইলে তাঁদের হাতে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট তুলে দেওয়া হবে। কিন্তু পুলিশের দাবি, তখন কোনও চিকিৎসকই সাড়া দেননি। ময়নাতদন্তের রিপোর্টও পুলিশের কাছ থেকে চাননি। কাজেই প্রশ্ন থাকছেই, ঘটনাপ্রবাহের জেরে দানা বেঁধে ওঠা অভয়ার ন্যায়বিচারের আন্দোলনের সুবাদে নিজেদের দাবিদাওয়ার আখের গুছিয়ে নিতেই কি ময়নাতদন্তে থেকেও তা বেমালুম চেপে গিয়েছিলেন জুনিয়র ডাক্তাররা? না কি আন্দোলনের অভিঘাত যে এতদূর গড়াবে সেটাই তারা আগাম আঁচ করতে পারেননি? শেষমেশ দ্বিচারিতা ফাঁস হতেই এখন তামাম অভিযোগের সঙ্গে নিজেদের ছোঁয়াচ এড়াতেই আন্দোলনের আড়াল খুঁজছেন ‘বিপ্লবী’ জুনিয়র ডাক্তাররা?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.