স্টাফ রিপোর্টার: মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সতর্কবার্তার পর ২৪ ঘণ্টাও কাটল না৷ লাগামছাড়া বিল নিয়ে টানাপোড়েনের জেরে শহরে রোগীমৃত্যুর অভিযোগ৷ কাঠগড়ায় বাইপাসের ধারের একটি বেসরকারি হাসপাতাল ‘অ্যাপোলো’৷ মৃত সঞ্জয় রায়ের (৩১) বাড়ি হুগলির ডানকুনিতে৷ পরিবারের অভিযোগ, সিটি স্ক্যানের নামে শুধুমাত্র অতিরিক্ত মুনাফা লাভের আশায় রোগীকে ‘ভেণ্টিলেশন’-এ দিয়েছিল ওই বেসরকারি হাসপাতাল৷ সব মিলিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চিকিৎসার বিল করে প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ টাকা৷ পরিবারের তরফে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় রোগীকে এসএসকেএমে স্থানান্তরিত করা হবে৷ তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহায্যে সেখানে বেড মিলতেই রোগীকে নিয়ে যেতে চান তাঁরা৷ কিন্তু বিপুল অঙ্কের বিল পুরো না মেটানো হলে রোগীকে ছাড়া হবে না বলে জানিয়ে দেয় অ্যাপোলো৷ বিল নিয়ে টানাপোড়েনের জেরে এসএসকেএমে নিয়ে যেতে অনেকটাই দেরি হয়ে যায়৷ আজ, শুক্রবার ভোর তিনটে নাগাদ এসএসকেএম হাসপাতালে মৃত্যু হয় সঞ্জয়বাবুর৷ এসএসকেএমের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, লিভারে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের জেরে ওই ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে৷ এদিকে ঘটনার কথা স্বীকার করলেও এ বিষয়ে কোনও মন্তব্যে নারাজ অ্যাপোলো কর্তৃপক্ষ৷ ঘটনার খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে এসএসকেএমে যান রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী মদন মিত্র৷ অ্যাপোলোর বিরুদ্ধে তাঁর কড়া হুঁশিয়ারি, “মৃতের পরিবারের সমস্ত টাকা ফেরত্ দেবে বলে জানিয়েছে অ্যাপোলো কর্তৃপক্ষ৷ টাকা ফেরত্ না হলে হাসপাতাল বন্ধ করে দেওয়া হবে৷ এই ধরনের ঘটনা কখনওই বরদাস্ত করা হবে না৷” এদিকে এদিনই অ্যাপোলোর বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ জানানো হবে বলে মৃতের পরিবারের তরফে জানানো হয়৷
সঞ্জয়বাবু হাওড়ায় এক ঠিকাদারের অধীনে কাজ করতেন৷ বাড়িতে স্ত্রী ও একটি দেড় বছরের সন্তান রয়েছে৷ গত ১৬ ফেব্রুয়ারি বাইকে চেপে কাজে যাচ্ছিলেন সঞ্জয়বাবু৷ সেই সময় দাশনগর থানার কাছে একটি ছোট ম্যাটাডর তাঁর বাইকে ধাক্কা মারে৷ বাইক থেকে পড়ে যান তিনি৷ গুরুতর জখম অবস্থায় তাঁকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়৷ কিন্তু সঞ্জয়বাবুর শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় ওইদিন দুপুরে কলকাতায় বাইপাসের ধারে অ্যাপোলোতে নিয়ে আসা হয়৷ সেখানে চিকিৎসা শুরু হয়৷
তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, চিকিৎসকরা প্রায় প্রতিদিনই রোগীর শরীরের নিত্যনতুন সমস্যার কথা জানাচ্ছিলেন৷ সঞ্জয়বাবুর লিভারে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল৷ তাঁর সিটি স্ক্যানের প্রয়োজন রয়েছে বলেও জানান তাঁরা৷ কিন্তু তা না করে রোগীকে চার ঘণ্টা ওই অবস্থায় ফেলে রাখা হয়৷ পরিবারের তরফে বার বার সিটি স্ক্যানের জন্য আবেদন জানানো হলেও কথা শোনেনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ৷ রোগীকে দীর্ঘক্ষণ ফেলে রাখার পর সিটি স্ক্যানের নাম করে তাঁকে দিয়ে দেওয়া হয় ভেণ্টিলেশনে৷ পরিবারকে জানানো হয় যে সিটি স্ক্যানের রিপোর্ট ভাল রয়েছে৷ কিন্তু সঞ্জয়বাবুর শারীরিক অবস্থা ক্রমেই খারাপ হতে থাকে৷ এদিকে লাগামহীনভাবে বাড়ছিল হাসপাতালের বিলও৷ এই অবস্থায় সঞ্জয়বাবুকে এসএসকেএমে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়৷ অ্যাপোলো কর্তৃপক্ষ মোট বিল করেছিল ৭ লক্ষ ৪১ হাজার৷ ওই টাকার প্রায় অর্ধেক মিটিয়েও দেওয়া হয়৷ বিল মেটাতে ফিক্সড ডিপোজিটও জমা করা হয় হাসপাতালের কাছে৷ সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহায্যে এসএসকেএমে ভর্তির সমস্ত ব্যবস্থাও হয়ে যায়৷ কিন্তু পুরো টাকা না দেওয়া পর্যন্ত রোগীকে কোনওমতেই ছাড়া হবে না বলে জানায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ৷ পরিবারের তরফে আবেদন জানানো হয়, রোগীকে ছেড়ে দেওয়া হোক৷ এসএসকেএমে তাঁর দ্রূত চিকিৎসা শুরু করা প্রয়োজন৷ শীঘ্রই সমস্ত বিল মিটিয়ে দেওয়া হবে৷ কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোনও কথা শোনেনি বলে অভিযোগ৷ হাসপাতালের সিইও-র কাছে গিয়েও কোনও লাভ হয়নি৷ বিল নিয়ে এই টানাপোড়েনের জেরে রোগীকে এসএসকেএম নিয়ে যেতে অনেকটাই দেরি হয়ে যায়৷ রাতে তাঁকে অ্যাপোলো থেকে ছাড়িয়ে এসএসকেএমে নিয়ে যাওয়া হলেও ভোর তিনটেয় মারা যান তিনি৷ ঘটনাপ্রসঙ্গে অ্যাপোলোর তরফে সোমনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, “আমরা বিষয়টি জানি৷ কিন্তু এখনই কোনও মন্তব্য করা সম্ভব নয়৷” মৃতের ছোটবেলার বন্ধু শুভম মুখোপাধ্যায় বলেন, “বেসরকারি হাসপাতালের গাফিলতিতে এভাবে তাঁর বন্ধুকে অকালে হারাতে হল৷ এই ক্ষতি অপূরণীয়৷” তাঁর কথায়, যতক্ষণে সঞ্জয়বাবুকে এসএসকেএমে আনা হয়েছিল ততক্ষণে তাঁর অবস্থা সঙ্কটজনক হয়ে পড়ে৷ পেটের ভিতরে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের জেরে অপারেশন করাও আর সম্ভব ছিল না বলে এসএসকেএমের চিকিৎসকরা জানিয়ে দেন৷ রাতের দিকে হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে মৃত্যু হয় তাঁর৷
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.