ক্ষীরোদ ভট্টাচার্য: বছরের প্রথম বৃষ্টিমুখর সকাল। মধ্য কলকাতার (Kolkata) এক বহুতলের দোতলায় পড়ার ঘরে বসে শতায়ু এক শিক্ষক-চিকিৎসক ছাত্রকে বলছেন, ‘‘দেখুন, চিকিৎসাবিজ্ঞান যে ভাবে এগোচ্ছে, একশো বছর বাদে তা চলবে জিনথেরাপির (Gene Therapy) উপর ভিত্তি করে। জিনই বলে দেবে, কে কত দিন বাঁচবেন, কার শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা কতটা।’’ পাশাপাশি জানাচ্ছেন, সুস্থ থাকার জন্য কঠোর শরীরচর্চার দরকার নেই। কিন্তু সব ক্ষেত্রে নিয়ম মেনে চলতে হবে। আর সময়মতো খেতে হবে, এক মিনিট এদিক-ওদিক হওয়া চলবে না। ‘‘আমাকে দেখুন। আমিষ-নিরামিষ সব খাই, কোনও বাছবিচার নেই। কিন্তু ঘড়ি ধরে খাই। আর হাসিখুশি থাকি। জীবনকে ভালবাসি। একশো চার বছরেও সুস্থ-সচল হয়ে বেঁচে থাকার এটাই বোধহয় আসল চাবিকাঠি।’’
একটানা কথাগুলো বললেন যিনি, তিনি জীবদ্দশায় কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছেন। পদ্মশ্রী (Padmasree) চিকিৎসক ডা. মণি ছেত্রী। বয়স আদতে সংখ্যামাত্র – এই প্রবচনকে হাতে-কলমে প্রমাণিত করে ১০৪ বছর বয়সেও যাঁর প্রতিটি দিনের প্রতিটি মুহূর্ত জীবনের উদযাপনে ভরপুর। সৃষ্টি ও কর্মোদ্যোগের ভিড়ে সেখানে হতাশা বা ক্লান্তির তিলমাত্র ঠাঁই নেই। সৌজন্য ও ভদ্রতারও প্রতিমূর্তি। ছাত্র হোন বা পরিচিত-অপরিচিত, সকলকে আপনি সম্বোধন। দেখা হলে উঠে দাঁড়িয়ে করজোড়ে নমস্কার, বিদায়বেলাতেও। মনে-প্রাণে আদ্যন্ত বাঙালি মণি ছেত্রীর স্পেশ্যাল সিগনেচার। এসএসকেএমের (SSKM) প্রাক্তন অধিকর্তা, এ যাবৎ রাজ্যের সফলতম স্বাস্থ্য-অধির্কতা মণিবাবুর অগণিত ছাত্র ছড়িয়ে ভারত-সহ বিশ্বের প্রান্তে প্রান্তে। তাঁদের অনেকে অবসরও নিয়ে ফেলেছেন। একাধারে কৃতী ছাত্র, শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ও চূড়ান্ত সফল প্রশাসক। আবার তেমনই ছাত্রসুলভ অনুসন্ধিৎসা এখনও হাড়ে-মজ্জায় বহাল।
ভোর চারটেয় ঘুম থেকে ওঠা। স্নান করে কিছুক্ষণ পুজোর ঘরে। দোতলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে বারান্দায় আধঘণ্টা হাঁটা। চা-বিস্কুট, মুড়ি দিয়ে প্রাতরাশ। তারপরেই রিডিং রুমের কাঠের চেয়ারে-টেবিলে শুরু দিনের কাজ। কাজ মানে পড়াশোনা, লেখাপত্র। ঠিক সেই ছাত্র ও চিকিৎসক জীবনের মতোই। তাবড় চিকিৎসকদের শ্রদ্ধেয় ‘স্যর’ এখনও ডাক্তারিশাস্ত্রের নতুন বই প্রকাশ হলে সঙ্গে সঙ্গে পড়বেন। টেবিলে ডাঁই করা ফার্মাকোলজি-মেডিসিনের প্রথম-দ্বিতীয় সংস্করণ সহ বহু বই। সে সব থেকে খাতায় নোট করবেন। খাতা জুড়ে হাতে লেখা বিভিন্ন রোগ ও ওষুধের নাম। কোনও ছাত্র এলে খাতা খুলে প্রশ্ন। রোগ ও ওষুধ নিয়ে নিরন্তর আলোচনা।
ঠিক সেই কর্মজীবনের মতো। উদ্দীপনায় কোনও ঘাটতি নেই। সামনে বসা এক ছাত্র-অধ্যাপককে বললেন, ‘‘বই লেখার ইচ্ছে আছে। কিন্তু কম্পিউটারে টাইপিং তো করতে পারি না! একজন কম্পিউটারে টাইপ করতে রাজি হলেন, ওয়ার্ডপিছু ফি এক টাকা। দু’দিন পরে জানালেন, দশ হাজার শব্দ হয়েছে। ওঁকে দশ হাজার টাকা দিয়ে দিলাম। এভাবে মোটে দু’শো পাতা হয়েছে, তিনশো পাতা লেখা বাকি।’’
‘স্যর’ অবশ্য প্রত্যয়ী যে, শিগগিরই বাকি তিনশো পাতা লেখা হয়ে যাবে। সামনে বসা ছাত্র, তথা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যাপক ডা. সৌমিত্র ঘোষের দিকে স্মিত হাসলেন তাঁর শিক্ষক, ‘‘শুনুন ডাক্তার ঘোষ। আমার পরিবারের আট জন কেউ পঁচাত্তরে, কেউ আশি বছরে মারা গিয়েছেন। অথচ আমি এখনও বেঁচে। কেন জানেন?’’ যেন ডুবে গিয়েছেন এসএসকেএমের শিক্ষকতার ফেলে আসা দিনগুলোয়। ছাত্র পড়ানোর ঢঙে বলে চলেছেন, ‘‘জিন, জিন। এ সবের পিছনে জিনের খেলা। আমার শরীরে এমন কোনও জিন আছে, যার দৌলতে একশো চারেও আমি সুস্থ। সবটা সে-ই নিয়ন্ত্রণ করছে। দেখে নেবেন, একশো বছর পরে চিকিৎসাবিজ্ঞান চলবে জেনেটিক মেডিসিনের ভিত্তিতে।’’ ওঁর পর্যবেক্ষণ, ‘‘মাতৃজঠরে থাকা ভ্রূণে একটামাত্র কোষ থাকে। দশ মাস পেরিয়ে শিশু জন্মায় ২৬ বিলিয়ন সেল নিয়ে। এটা কি অবাক করে না?’’
দীর্ঘ জীবনে অসংখ্য মানুষের সংস্পর্শে এসেছেন। ডা. বিধানচন্দ্র রায় থেকে বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমান, কে নেই সে তালিকায়! অসংখ্য স্মৃতি ভিড় করে আছে। জানালেন, ডা. বিধান রায় মুখ্যমন্ত্রীর গুরুদায়িত্ব সামলে যে ভাবে রাজ্যের স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতি ঘটিয়েছিলেন, কোনওদিনও ভুলতে পারবেন না। চিকিৎসক দিবসে (Doctors’ Day) কী বার্তা দেবেন? প্রবাদপ্রতিম চিকিৎসক-অধ্যাপক ডা. মণি ছেত্রীর উত্তর, ‘‘এখন ডাক্তারবাবুদের কাজ অনেক বেড়েছে। নতুন-নতুন বিভাগ তৈরি হয়েছে। তবে ডাক্তারদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের খবর কাগজে পড়লে মনখারাপ হয়ে যায়। সবাই যেন সহনশীল হয়।’’