পবিত্র সরকার: টেলিভিশনে খবর এখন আর দেখি না। কাজেই অনেক ভাল দৃশ্য যেমন, তেমনই অনেক দুঃসহ দৃশ্যও দেখা হয় না। সে একদিক থেকে ভাল, ঘটনার প্রবল অভিঘাত দুর্বল স্নায়ুকে আক্রমণ করে না। এটা খানিকটা আত্মরক্ষার কৌশল। বুড়ো বয়সে আমার মতো লোককে এই কৌশল নিতেই হয়। তাই মঙ্গলবার বিদ্যাসাগর কলেজে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার চলচ্ছবি আমি দেখিনি। আর দেখিনি যে, তা ভালই হয়েছে। কিন্তু যতই চেষ্টা করি, ‘খবর’ থেকে তো আত্মরক্ষা করা যায় না। মিডিয়ার ভিতরের বন্ধুরা যেমন আছেন, তার বাইরের অজস্র বন্ধু আছেন, যাঁরা উদ্বিগ্ন হয়ে ফোন করেন। ‘শুনেছেন ঘটনা! কী বলবেন?’
[আরও পড়ুন: বিশ্বভারতীতে বেলাগাম ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদ, আন্দোলনে ছাত্রছাত্রীরা]
ভাগ্যিস শুনেছি, দেখিনি। দেখলে হয়তো কথা বলাই সম্ভব হত না। আর সত্যিই তো, কী বলব? আমি বলার কে? তবে, বলার এই যে, আমি লোকটা বাঙালি। আমি বিদ্যাসাগরের উত্তরাধিকার অযোগ্য কাঁধে বহন করছি, তাঁর সাহিত্য, তাঁর সমাজভাবনা, তাঁর অতলান্ত মানবপ্রেম, তাঁর নারীশিক্ষা আর নারীর ক্ষমতায়নের নানা কাজের অর্থ বোঝার জন্য চেষ্টা করতে করতে অন্যান্য অনেক বাঙালির মতোই তুচ্ছ জীবনের কিছুটা মূল্যবান সময় ব্যয় করেছি। সেই আমার কাছেই এই খবর এসে পৌঁছল যে, রাজনৈতিক দলের আক্রমণে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা পড়েছে!
[আরও পড়ুন: কে জিতছে পুরুলিয়ায়? লাখ টাকার বাজি বিজেপি-তৃণমূল সমর্থকের]
আমরা এখন বিদ্যাসাগরের দ্বিশততম জন্মবার্ষিকীর জন্য প্রস্তুত হচ্ছি। আবার নতুন করে তাঁর মুখোমুখি হয়ে নিজেদের চিন্তাকে, আবেগকে কিছুটা শুদ্ধ করে নেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছি। এমন সময়েই ঘটল এই ঘটনা। এর আগে, সাতের দশকের বছরগুলিতে এরকম ঘটনা ঘটেছিল। সেটা তবু ছিল একটা ‘দর্শনগত আক্রমণ’। সে আদর্শ যতই ভ্রান্ত হোক। এক্ষেত্রে তো আদর্শের কোনও বালাই নেই। অন্ধ আক্রোশে বিদ্যাসাগর মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন। সেই সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে বাঙালির যত বুদ্ধি, শিক্ষা আর সংস্কৃতির অহংকার। তার তথাকথিত রেনেসাঁস বা নবজাগরণের যত সুফল, তার নিজের সম্বন্ধে আত্মম্ভরিতা, তার অন্যদের তুচ্ছ করার মারাত্মক প্রবণতা। এবার আমরা পরস্পরের দিকে তাকাব কী করে… আমাদের সন্তানদের আমরা কী বলব? বলব যে, রাজনীতির জয়-পরাজয়ই চরম। তার কাছে মানুষের মহত্ত্ব, কীর্তি, গৌরব, সভ্যতা, সংস্কৃতি কিছুই নয়! বাংলাদেশের নিরীশ্বর মহৎ বুদ্ধিজীবী আহমদ শরিফ ওই ভাঙা-মূর্তির মানুষটি সম্বন্ধে বলেছিলেন, “বাঙালির ওই এক ঈশ্বর হলেই চলবে, আর কোনও ঈশ্বরের তার দরকার নেই।” ওই মানুষটিকে মৌলবাদীরা ‘মুরতাদ’ বা যে ‘তাঁকে হত্যা করবে সে স্বর্গে যাবে’ এমন ঘোষণা করেছিল। আজ আহমদ শরিফ বেঁচে থাকলে হয়তো তাঁকে স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ বেছে নিতে হত।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.