গৌতম ব্রহ্ম: তিনটি দাবি। আর তাতেই লুকিয়ে জট কাটার পাসওয়ার্ড। এনআরএসের আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তার ও হবু ডাক্তারদের আশা ছিল, তিনটির মধ্যে অন্তত দু’টি দাবিপূরণ বুধবার হয়ে যাবে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘটনার নিন্দা করে কড়া বিবৃতি দেবেন। কথা বলবেন আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে। কিন্তু তা হয়নি। সম্ভাবনা তৈরি হলেও জখম জুনিয়র ডাক্তার পরিবহ মুখোপাধ্যায়কে দেখতে যাননি মমতা। বরং তাঁর নির্দেশে রাজ্যের স্বাস্থ্য দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য যান ইনস্টিটিউট অফ নিউরোসায়েন্সে। কথা বলেন পরিবহর পরিবারের সঙ্গে। চিকিৎসার যাবতীয় ব্যয়ভারও গ্রহণ করে রাজ্য সরকার।
এই পরিস্থিতিতে আন্দোলনকারী ডাক্তারবাবুরা দ্বিধাগ্রস্ত। একদল চাইছেন আন্দোলন চলুক। অন্যদল বলছেন, ‘এবার তালা খুলুক এনআরএসের। না হলে আম জনতার কাছে ভুল বার্তা যাবে।’ ডাক্তার সংগঠনের প্রতিনিধিদের গলায়ও সেই দ্বিধার সুর। ডা. কুণাল সাহার ‘পিপলস ফর বেটার ট্রিটনেন্ট’ ছাড়া আন্দোলনকারীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন সবাই। কেউ চেম্বার বন্ধ করে এসেছেন। কেউ অপারেশন মুলতবি রেখে যোগ দিয়েছেন মিছিলে। এদিন ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরাম’-এর নেতৃত্বে এনআরএস থেকে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ পর্যন্ত মিছিল করেন ডাক্তারবাবুরা।
এদিকে জট কাটাতে এদিন স্বাস্থ্যভবনে স্বাস্থ্যকর্তাদের নিয়ে এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করেন স্বাস্থ্যসচিব রাজীব সিনহা। এক লিখিত বিবৃতিতে তিনি বলেন, “এনআরএসের ঘটনা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। হামলাকারীদের পাঁচজনকে দ্রুত গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের পুলিশ হেফাজতে নিয়ে তদন্ত করছে পুলিশ। মুখ্যমন্ত্রী নিজে তদন্তের গতি প্রকৃতিতে নজর রাখছেন। আমাদের আবেদন, আন্দোলন প্রত্যাহার করুন জুনিয়র ডাক্তাররা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হোক।”
[ আরও পড়ুন: ২৪ ঘন্টার মধ্যে মোহভঙ্গ, বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে ফিরলেন একাধিক পঞ্চায়েত সদস্য ]
এদিকে, উৎকণ্ঠা কাটিয়ে সুস্থ হচ্ছেন পরিবহ। এদিন আইএনকে-এর তরফে নিউরো সার্জন ডা. পার্থ ঘোষ ও মেডিক্যাল সুপার ডা. প্রসেনজিৎ বর্ধন জানান, পরিবহ বিপন্মুক্ত। কথা বলছেন। নিজে খাবার খাচ্ছেন। ভবিষ্যতে সমস্যা যাতে না হয় তার জন্য অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। অস্ত্রোপচার সফল। সংক্রমণ ঠেকাতে কড়া অ্যান্টিবায়োটিক চলছে।
এমন পরিস্থিতিতে এনআরএসের ‘সেভ দ্য সেভিয়র’ আন্দোলনের নেতারা বুধবার রাতে বৈঠকে বসেন। দিনভর প্রচুর ডাক্তার নেতা এসেছেন। দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে তাঁরা আন্দোলনকারীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু বেশিরভাগই এমার্জেন্সি পরিষেবা চালুর পক্ষে মত ব্যক্ত করেন। ডাক্তারদের একাংশ মনে করছেন, এই নিয়ে দু’দিন এমার্জেন্সি, ওপিডি বন্ধ। মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙছে। এবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হোক। যদিও আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তাররা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, “আজ বৃহস্পতিবারও এনআরএসে এমার্জেন্সি ও ওপিডি পরিষেবা বন্ধ থাকবে। তিন দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত জুনিয়রদের পক্ষে কাজে যোগ দেওয়া সম্ভব নয়। আমরা চাই না আরও কোনও পরিবহ মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ুক।”
বুধবারও দিনভর ভোগান্তির ছবি চোখে পড়েছে। এনআরএস তো বটেই কলকাতার অন্য মেডিক্যাল কলেজগুলিতেও। কলকাতা লাগোয়া ব্লক ও জেলা হাসপাতালেও চরম নাকাল হয়েছেন রোগীরা। আউটডোর খোলা থাকলেও ডাক্তার আসেনি। এমার্জেন্সিতে আসা রোগীদের বেশিরভাগকেই হয় ‘রেফার’ না হয় ফিরিয়ে দিয়েছেন ডাক্তারবাবুরা। এই পরিস্থিতিতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার আবেদন জানিয়েছেন সবাই। তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, চিকিৎসকদের উপর আক্রমণের ঘটনা নিন্দনীয়। প্রশাসন ব্যবস্থা নিয়েছে। পাঁচজন হামলাকারী গ্রেপ্তার হয়েছে। গোটা বিষয়টিতে মুখ্যমন্ত্রী নজর রাখছেন। মুখ্যসচিব, স্বাস্থ্য দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বাস্থ্যসচিব বৈঠক করেছেন। কিন্তু দূর-দূরান্ত থেকে চিকিৎসার জন্য এসে যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন মারা যাচ্ছেন তার দায় কার?
[ আরও পড়ুন: কৃতীদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে শিক্ষক বদলি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে স্মারকলিপি জেনকিনসের পড়ুয়াদের ]
বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ জানিয়েছেন, “ডাক্তাররা বাধ্য হয়েই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ডাক্তাররাই আজ বিপন্ন। ডাক্তারদের সার্ভিস মাস্ট। কিন্তু সিকিউরিটি ফার্স্ট। ডাক্তাররা অবশ্যই তাঁদের সেবা-দায়িত্ব পালন করুক। হরতাল তুলে নিক। কাজে যোগ দিক। সরকার যেন তাঁদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করে।” দিলীপবাবু আরও জানান, “একটি বিশেষ সম্প্রদায় হাসপাতালে অশান্তি করেছে। তাই মুখ্যমন্ত্রী কিছু বলছেন না। আমি কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষবর্ধনের সঙ্গে কথা বলব।” প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্র জানিয়েছেন, “মায়া ঘোষের নেতৃত্বে কংগ্রেসের একটি প্রতিনিধিদল এনআরএসে যায়। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলে। হাসপাতালের বাইরে রোগী ও পরিজনদের ভিড়ের মিছিল থমকে দিয়েছে চিকিৎসা পরিষেবা। এই পরিস্থিতিতে মুখ্যমন্ত্রীর উচিত আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলে সমস্যা মেটানো।”
এদিকে, এনআরএস কাণ্ডে ধৃত পাঁচজনকে এদিন শিয়ালদহ কোর্টে হাজির করা হয়। তাদের আগামী ১৯ জুন পর্যন্ত পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন বিচারক। পাশাপাশি এনআরএসের গেটের সামনে থাকা সিসিটিভ ফুটেজও সংগ্রহ করে খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.