বুদ্ধদেব সেনগুপ্ত: ক্ষমতার দম্ভে সেদিন ধরাকে ‘সরা’ জ্ঞান করেছিলেন। রেড বুক ম্যানুয়ালে বলা রাজনীতিতে ছাত্র, যুব, নবীন রক্তের জোগানকে নিশ্চিত করার পথকে ভুলেছিলেন মোহের ঘোরে। পাশাপাশি ফ্রন্টের মধ্যেই কথায় কথায় বিরোধ বাঁধিয়েছেন সিপিএমের (CPM) সঙ্গে। ছাত্র-যুবদের মধ্যেও সেই দ্বন্দ্বের চোরাস্রোত ছিল বহমান। অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয় পার্টিতে নতুন প্রজন্মের ভিত। ক্ষমতার সূর্য ডোবার পর ভবিষ্যতের প্রশ্নে আতঙ্কিত তিন বাম শরিক নেতৃত্ব। রাজনীতিতে ক্রমশ অপাংক্তেয় হওয়ার সময়ে আফসোস আর অসম্ভবের স্বপ্ন নিয়ে আজ দিন কাটছে তাঁদের।
১৯৭৭ থেকে ২০১১। টানা ৩৪ বছরের রাজত্বকালে একমাত্র লক্ষ্য ছিল যেন তেন প্রকারে ক্ষমতার চেয়ার দখল করে রাখা। সে সময় লালবাতির গাড়ি, নিরাপত্তারক্ষীদের বেষ্টনী ও হাজারো সরকারি সুযোগ-সুবিধার মোহে পার্টিকেই ব্রাত্য করেছিলেন অনেক বাম নেতা। তার ফলই আজ হাতেনাতে পাচ্ছে বামফ্রন্টের তিন শরিকদল সিপিআই (CPI), আরএসপি (RSP) ও নেতাজির দল ফরওয়ার্ড ব্লক (FB)। তাঁদের মাথার উপর এখন অস্তিত্বের সংকট। আরব সাগরের পাড়ে দুই রাজ্য কেরল (Kerala) ও তামিলনাড়ুতে (Tamil Nadu) টিমটিম করে দলের বাতি জ্বললেও বাংলায় ভাঁড়ার শূন্য। হাতেগোনা গুটিকতক পঞ্চায়েত ও পুরপ্রতিনিধি থাকলেও তা পাতে দেওয়ার নয়। তাও আবার এঁদের বেশিরভাগের জয় ফ্রন্টের বড় শরিক সিপিএমের বদান্যতায়। জেতার পর অনেকে আবার দলত্যাগ করে তৃণমূলমুখীও (TMC) হয়েছেন।
একদা রাজ্য রাজনীতিতে আলোচনার কেন্দ্রে থাকা পার্টির অধুুনা দুরবস্থার কথা ভাবলেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন আরএসপির সাধারণ সম্পাদক মনোজ ভট্টাচার্য। তাঁর স্পষ্ট স্বীকারোক্তি, “পরিস্থিতি এখন ভাবনাচিন্তার বাইরে চলে গিয়েছে। ভয়ংকর এক সমস্যার মধ্য দিয়ে চলেছি।” পার্টির ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্নের সামনে তাঁর কুণ্ঠিত জবাব, “দয়া করে আর বিড়ম্বনায় ফেলবেন না! শীর্ষপদে বসে পরবর্তী প্রজন্মের কথা ভাবলেই চিন্তা হয় এখন। নতুনদের পার্টিতে আকৃষ্ট করার জন্য নীতি ও আদর্শ ছাড়া কিছুই রেখে যেতে পারছি না।”
বাস্তব পরিস্থিতি স্বীকার করে নিচ্ছেন সিপিআইয়ের রাজ্য সম্পাদক স্বপন বন্দে্যাপাধ্যায়ও। রাজনীতির প্রতি মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের অনীহা বাম রাজনীতিকে আরও সংকটের মুখে দাঁড় করিয়েছে বলে আপাতত ব্যাখ্যা তাঁর। বিষয়টি নিয়ে পার্টি নেতৃত্ব গভীর ভাবনাচিন্তা করলেও এখনও আশার আলো মেলেনি, স্পষ্ট স্বীকারোক্তি তাঁর। স্বপনবাবু জানান, “পার্টি এখন যে সংকটের মুখোমুখি, তা আমাদের ভাবাচ্ছে। পার্টির অন্দরে যে ভুলত্রুটি রয়েছে, তা সংশোধনের প্রক্রিয়া চলছে।” তবে এই সংকট থেকে বেরতে না পারলে ভবিষ্যৎ কী– সেই প্রশ্নের জবাব অবশ্য মেলেনি তাঁর কাছ থেকে।
দুই বাম শরিকের থেকে অবশ্য ভিন্ন মত নেতাজির দল ফরোয়ার্ড ব্লক নেতাদের। তাঁদের অবস্থা – ‘ভাঙব তবু মচকাব না’। দলের সাধারণ সম্পাদক দেবব্রত বিশ্বাসের যুক্তি, “নেতাজি যতদিন ভারতবাসীর মনে থাকবে ততদিন ফরওয়ার্ড ব্লকও থাকবে।” তাই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে এখনও বহু মানুষ পার্টির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি। কমবয়সি নতুন মুখ পার্টিতে এলেই যে বামেরা ঘুরে দঁাড়াবে তা মানতেও নারাজ দেবব্রত বিশ্বাস। নিজের পক্ষে যুক্তি, “কারণ শেষ পুরসভা ভোটেও যে দু’জন বামপ্রার্থী জয়ী হয়েছেন তাঁরা কেউই নবীন নন। বরং নবীনরা এখনও ভোটের ময়দানে সফল হতে পারেনি।”
প্রবল সংকটের মুখে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য নীতি ও আদর্শই তাঁদের একমাত্র ‘ফিক্সড ডিপোজিট’ বলে মেনে নেন তিন শরিকই। মনোজ ভট্টাচার্যর মতে, নীতি-আদর্শের পরিবর্তন হবে না। সেই বিশ্বাস থেকেই একদিন না একদিন ফের নবীন প্রজন্ম পার্টিতে আসবে। বামপন্থার প্রতি কমবয়সিদের ঝোঁক বাড়ছে। এটাই আশার আলো বলে মনে করেন তিনি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.