স্টাফ রিপোর্টার: ‘কলোনিয়াল হ্যাংওভার’ বনাম স্বদেশিয়ানা। বিতর্কের ঝড় তুলে ‘সেরেমনিয়াল রোব’ বিদায় নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত বাংলার বিদগ্ধ মহল। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের (Jadavpur University) সমাবর্তন মঞ্চে ‘সেরেমনিয়াল রোব’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের নবনিযুক্ত রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস (CV Anand Bose)। বলেছিলেন, ‘‘এটি ঔপনিবেশিকতার চিহ্ন। পোশাকবিধি এমন হওয়া উচিত যার মাধ্যমে আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি প্রতিফলিত হবে, ব্রিটিশ সংস্কৃতি নয়।’’ রাজ্যপালের এই মন্তব্য কতটা যুক্তিযুক্ত? সত্যিই কি রোব (Ceremonial Robe) বা গাউন ব্রিটিশ সংস্কৃতি তথা ঔপনিবেশিকতার প্রতীক হিসাবে বর্জন করা উচিত? এই প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত শিক্ষাবিদ-বিশিষ্টজনেরা।
রাজ্যপালের মন্তব্যের কঠোর সমালোচনা করেন শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার। বলেন, ‘‘এই ধরনের ছেলেমানুষি কথা শুনলে বোকা বোকা লাগে। এক দেশ থেকে অন্য দেশে সাংস্কৃতিক বিস্তার হয়। সাংস্কৃতিক মিশ্রণ হয়। এটা উপনিবেশের সঙ্গে হতেই পারে। ঔপনিবেশিকতা থেকেই আমরা গেঞ্জি পরা শিখেছি। উনি কি গেঞ্জিটা বাদ দেবেন? প্যান্ট-শার্ট কলোনির পোশাক। উনি কি ঔপনিবেশিকতার উত্তরাধিকার বলে সেগুলো বাদ দেবেন? ইদানীং বিজেপি নেতাদের মুখে এই ধরনের আবোল তাবোল সব কথাবার্তা আসছে।’’
আবার রাজ্যপালের মন্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য, ‘‘ঠিক কথাই বলেছেন। রোব তো ব্রিটিশ আমল থেকে চলে আসছে। রোবের জায়গায় অন্য কিছু ভাবলে ভাল ছিল। রোব ব্রিটিশ সংস্কৃতির প্রতীক। তাই এটার বদলে অন্য কিছু ভাবলে ভাল।” ‘সেরেমনিয়াল রোব’ নিয়ে রাজ্যপালের বক্তব্যকে সমর্থন করেছেন নৃত্যশিল্পী অলোকানন্দা রায়। তিনি বলেন, ‘‘আমি মনে করি, নতুন রাজ্যপালের বক্তব্যকে খোলা মনেই গ্রহণ করা উচিত। ‘কলোনিয়াল হ্যাংওভার’ কাটিয়ে বিশ্বভারতীর মডেলে সমাবর্তনের পোশাক হোক না! যাতে স্বদেশিয়ানার গন্ধ থাকবে, স্থানীয় ডিজাইন থাকবে। ক্ষতি কী!’’
সমাবর্তনে ‘রোব’ পরা যে একটি ব্রিটিশ সংস্কৃতি, তা মেনে নিয়েছেন শিক্ষাবিদ ও রাজ্যের সিলেবাস কমিটির চেয়ারম্যান অভীক মজুমদার। কিন্তু, ব্রিটিশ বা ঔপনিবেশিকতার চিহ্ন হলেই তা বর্জন করার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। অভীকবাবুর কথায়, ‘‘সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঐতিহ্য নির্মিত হয়। যে কোনও ঐতিহ্যকে বদলে ফেলার আগে আমাদের সমস্ত পরিপ্রেক্ষিত বিচার করে এগোনোই ভাল। ভারতবর্ষ একটা মিশ্র সংস্কৃতির দেশ। ঔপনিবেশিকতার বিরোধিতা নিশ্চয়ই সাধুবাদযোগ্য এবং স্বাগতও জানাচ্ছি।’’
পবিত্র সরকার এবং অভীক মজুমদার -দু’জনেরই প্রশ্ন, এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাও ঔপনিবেশিক শাসনের থেকে পাওয়া। তাহলে কি গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাটাই বর্জনীয়! এ প্রসঙ্গে পবিত্রবাবু বলেন, ‘‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা বা ব্যবস্থাটাই তো আমরা ঔপনিবেশিকতা থেকে পেয়েছি। নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা তো উপনিবেশের উত্তরাধিকার। সেগুলো তাহলে ছেড়ে দিতে হবে! আমার সত্যি সত্যি এই ধরনের কথা শুনলে গায়ে সুড়সুড়ি লাগে।’’
অভীকবাবুর কথায়, ‘‘আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাটাই তো ঔপনিবেশিকতার ফলাফল। তাহলে তো গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাটাকেই ফেলে দিতে হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল ১৮৫৭ সালে। যে সালটা সিপাহি বিদ্রোহের সাল। তাহলে কি সিপাহি বিদ্রোহের প্রতি সম্মান জানিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তুলে দেওয়া উচিত?’’ বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অমল মুখোপাধ্যায়ও রাজ্যপালের এই দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধেই মতপোষণ করছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘ওঁর এই বক্তব্যকে আমি সমর্থন করতে পারছি না। সমাবর্তনে যা যা করা হয়, সেটা চিরকালের ঐতিহ্য এবং পৃথিবীর সব বিশ্ববিদ্যালয়েই সেটা মানা হয়। কাজেই আমি মনে করি, তিনি ওই কথাটা বলে থাকলে, ঠিক বলেননি।’’
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.