কলহার মুখোপাধ্যায়: কলকাতা স্টেশনের ঠিক বাইরে রেলিং ঘেরা বাগানের ঝোপ থেকে কচি পাতা ছিঁড়ে মুখে পুড়ছিলেন বৃদ্ধ। দু’দিন অভুক্ত থাকার পরও যখন এতটুকু খাবারও জোটেনি, তখন উপায় কী? হাতের কাছে থাকা গাছের পাতা চিবিয়ে, জল দিয়ে গিলে কোনওরকমে টিকিয়ে রেখেছিলেন প্রাণটা। লকডাউনে কলকাতায় আটকে পড়ে এভাবেই কয়েকটা দিন কাটিয়েছেন উত্তরপ্রদেশের নাকাপুরা গ্রামের বাসিন্দা বৃদ্ধ গোরক্ষ সিং। না খেতে পাওয়ার কথা কাউকে বলতেও পারেননি। এই শহরও বুঝতে চায়নি তাঁর অভুক্ত থাকার যন্ত্রণা।
তবে সকলেই তো আর মুখ ফিরিয়ে থাকেন না। থাকেননি রাজারহাটের আসাদুল আর ফারুক। ঘটনাচক্রে তাঁরা দেখেছিলেন বৃদ্ধ গোরক্ষের পাতা খাওয়ার দৃশ্য। তারপর থেকে গত একমাস ধরে গোরক্ষ-সহ কলকাতা স্টেশনে আটকে পড়া ভিন রাজ্য ও অন্য জেলার ২৬ মানুষের জন্য ডাল-ভাতের সংস্থান করে যাচ্ছেন এই দুই যুবক। সকালে পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের তরফে খাবার দেওয়া হচ্ছে। রাতে রাজারহাটের ওই যুবক গিয়ে ২৬ জনকে খাইয়ে আসছেন নিয়মিত।
এই ঘটনা লকডাউনের একেবারে গোড়ার দিকের। বছর আশির গোরক্ষ সিং উত্তরপ্রদেশ থেকে এসেছিলেন এক ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা নিতে। সাত বছর আগে রাজমিস্ত্রির কাজ করেছিলেন সেই বাড়িতে, টাকা বাকি ছিল। লকডাউনের আগে ট্রেনে চড়ে কলকাতায় নামেন, বিধান নগর স্টেশন লাগোয়া ওই ব্যক্তির বাড়িতে যান। কিন্তু টাকা মেলেনি। এরপরই লকডাউনে শহরে আটকে পড়েন বৃদ্ধ। ঠাঁই হয় কলকাতা স্টেশনে। অশীতিপর গোরক্ষ সিংয়ের সঙ্গী বলছে দুটো লাঠি। তাদের সাহায্যেই হেঁটেচলে বেড়ান। অশক্ত শরীর, পকেটে এক কানাকড়িও নেই। পাতা খাওয়া ছাড়া তিনি আর কী-ই করতেন?
এ তো গেল গোরক্ষ সিংয়ের কথা। তিনি একা নন, বিহারের ছাপরার রবীন্দ্র যাদব কাজ করতেন কলকাতার এক বেসরকারি সংস্থায়। অসুস্থ হয়ে দেশের বাড়ি চলে যান। লকডাউন এর আগে সংস্থার কাছে টাকা নিতে আসেন। তবে বকেয়া পাননি। লকডাউন ঘোষণার প্রথম দিন পকেটের টাকা দিয়ে পাঁউরুটি কিনে খেয়ে ছিলেন। পরের দিন থেকে পয়সা শেষ। টানা দু’দিন স্রেফ স্টেশনের জল খেয়ে বেঁচে ছিলেন। তালিকা আরও লম্বা। শ্বাসকষ্ট নিয়ে চিকিৎসা করাতে আসেন উত্তরপ্রদেশের রাকেশ যাদব। লকডাউনে আটকে কলকাতা স্টেশনে। পকেটে একটি পয়সাও নেই। এখন অন্যের দেওয়া খাবারের ভরসায় ঠায় বসে থাকা স্টেশন চত্বরে। বিহারের ৭৫ বছরের সুধীর দত্ত এঁদের মধ্যে একটু স্বচ্ছল । এখনও ওর পকেটে কুড়ি টাকা রয়েছে। চাইলে নিজে থেকে বিস্কুট বা পাউরুটি কিনে খেতে পারেন। মহিলারাও রাত কাটাচ্ছেন কলকাতা স্টেশনের খোলা ফুটপাতে। মথুরা, বৃন্দাবনের কাজল পাল কলকাতা এসেছিলেন। কোচবিহারে তাঁর বাবার কাছে যাবার কথা ছিল। এখন আসাদুলদের দেওয়া ডাল-ভাতের আশায় বিকেল থেকে বসে থাকেন স্টেশনে। রায়গঞ্জের মনিকা সিং এসেছিলেন আরজি কর হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে। লকডাউনে আটকে গিয়েছেন। ফোনে যোগাযোগ রয়েছে পরিবারের সঙ্গে। তবে পেশায় দিনমজুর স্বামীর পক্ষে স্ত্রীকে রায়গঞ্জে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার আপাতত কোনও সংস্থান নেই। লকডাউন যে তাঁকেও বেকার করে দিয়েছে। অগত্যা খোলা আকাশের নিচেই আপাতত বিছানা মনিকার।
হাত-পা ওয়ালা মানুষের মতো দেখতে কিছু ‘জীব’কে ‘ফ্যান ফ্যান’ বলে চিৎকার করতে দেখেছিল মন্বন্তরের কলকাতা। লকডাউনের শহরে চারপেয়েদের মতো পাতা খাওয়ারও সাক্ষী রইল বসন্তদুপুর।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.