সুলয়া সিংহ: কথায় বলে, রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। মুখ্যমন্ত্রী এনআরএসে আসবেন নাকি জুনিয়র চিকিৎসকরা যাবেন নবান্নে? দড়ি টানাটানি অব্যাহত। আর এই লড়াইয়ের মধ্যে পিষে যাচ্ছে ওই অসহায় প্রাণগুলো। যাঁরা দূর-দূরান্ত থেকে শুধুমাত্র এই আশা নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন, যে বাড়ির অসুস্থ মানুষটাকে সুস্থ করে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন। কিন্তু হায় রে ইগো! সে যে কোনওভাবেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে দিতে রাজি নয়।
পরিবারের সদস্য পড়ে গিয়ে আহত। তাঁকে নিয়ে মুর্শিদাবাদ থেকে সোজা নীলরতন সরকার হাসপাতালে হাজির হয়েছেন হাজিবুল। এমার্জেন্সিতে নিয়ে যেতেই রোগীকে আউটডোরে নিয়ে যেতে বলা হয়। সেই মতো আবার ছোটেন আউটডোরে। গেট খোলা দেখে মনে আশার আলো জাগলেও পরমুহূর্তেই তা নিভে যায়। জানিয়ে দেওয়া হয়, আউটডোরে কোনও চিকিৎসকই নেই। রোগী দেখা হবে না। অগত্যা, ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা। কখন জট কাটবে, আদৌ কাটবে কি না, সে প্রশ্নের সদুত্তর মিলছে না। হাজিবুল বলছেন, “খবরে শুনেছিলাম, ডাক্তারদের আন্দোলনের চারটে দিন কেটে গিয়েছে। তাই ভাবলাম আজ হয়তো পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। কিন্তু কিছু হচ্ছে না। মাঝখান দিয়ে ভুগতে হচ্ছে রোগী আর তার পরিবারকে। কী করব জানা নেই।”
একই হাল বনগাঁ থেকে আসা আরেক পরিবারের। মেয়ে বাইক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত। গত ১৫ দিন ধরে এই হাসপাতালেই ভরতি। প্রথম দিকে চিকিৎসা ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু গত পাঁচদিন ধরে সবই শিকেয় উঠেছে। সাতদিন আগে যে ওষুধ লিখে দিয়েছিলেন চিকিৎসক, সেটাই চলছে। তারপর থেকে একবারও রোগীর অবস্থার খোঁজ নেননি চিকিৎসক। ওষুধ ফুরিয়ে গেলে কী হবে, জানা নেই অসহায় মায়ের। গাছের তলায় মাথায় হাত দিয়ে ঠায় বসে আক্ষেপের সুরে বলছেন, “অর্থের অভাবে মেয়েকে অন্য কোথাও নিয়ে যেতে পারছি না। কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে মেয়েটার কী হবে বুঝতে পারছি না।” কথাগুলো বলার সময় গলা ধরে এল তাঁর।
চিকিৎসক বনাম প্রশাসনের লড়াইয়ের মাঝে চোখের সামনে সাগর দত্ত হাসপাতালে সদ্যোজাতকে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়তে দেখেছে পরিবার। তাই ওই হাজার হাজার রোগী ও তাঁদের পরিবারের কাছে ‘জাস্টিস’-এর সংজ্ঞাটাই যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। এনআরএসে উপস্থিত রোগীর পরিবারও মেনে নিচ্ছেন, জুনিয়র চিকিৎসক পরিবহ মুখোপাধ্যায় যেভাবে রোগীর পরিবারের হাতে আক্রান্ত হয়েছে, তা অনুচিত। কিন্তু তাঁরা তো কোনও দোষ করেননি। তাহলে তাঁদের কেন শাস্তি পাচ্ছেন? কেন বিনা চিকিৎসায় প্রাণ হারাতে হচ্ছে তাঁদের প্রিয়জনকে? রোগীদের এই দুর্দশার দায় কে নেবে? চিকিৎসকদের প্রতিবাদী মঞ্চ থেকে তাঁদের হয়ে কথা বললেন কলকাতা হাই কোর্টের আইনজীবী রবিশংকর চট্টোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ডাক্তাররা কখনওই রোগীদের খারাপ চান না। চিকিৎসকের কাজই প্রাণ বাঁচানো। তাই এই অচলাবস্থার দায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রীর। তিনি বলেন, “মাত্র আধ ঘণ্টায় সমস্যা মিটে যেতে পারত। সিঙ্গুর আন্দোলনের সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিক্ষোভকারীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। এক্ষেত্রেও কি এই বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলোর কাছে আসা যেত না? উলটে তিনি বলেন, ডাক্তাররা নাকি নাম ও পদবি দেখে চিকিৎসা করে। এমন কথা কীভাবে বলতে পারেন তিনি?”
আইনজীবীর কথাতেই স্পষ্ট, এ লড়াই সহজে মেটার নয়। সুবিচারের চাহিদায় এই লড়াই পৌঁছে গিয়েছে অহংয়ের দ্বন্দ্বে। কিন্তু এসবের মধ্যে শাঁখের করাতের মতো হাল নিরীহ, অসহায় রোগীদের। উলুখাগড়ার প্রাণ হয়তো এভাবেই যায়, দুর্ভাগ্যজনকভাবে আরও যাবে৷
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.