নব্যেন্দু হাজরা: মায়ের গায়ের যেমন নিজস্ব গন্ধ থাকে, তেমনই সব শহরেরও নিজস্ব শব্দ থাকে। হাতেগোনা সেই কিছু শব্দই শহরের পরিচয় হয়ে ওঠে। নিজস্ব পরিচিতি দেয় তাকে। শহর থেকে কয়েক শো মাইল দূরে থাকলেও যে শব্দ কানে এলে মনে পড়ে যায় এক খণ্ড শহরটার কথা। ফিরে আসতে মন কেমন করে। স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে কত নস্ট্যালজিয়া। শহর কলকাতার জন্য মন কেমন করানো সেই শব্দগুলোর মধ্যে একেবারে উপরের দিকে থাকবে সরু লাইন ধরে ‘নড়িতে নড়িতে’ এগিয়ে চলা ট্রামের চাকার ঘটাং ঘটাং আওয়াজটা। মনে করিয়ে দেয় ছেলেবেলার কথা, উঠতি বয়সে প্রিয় মানুষের সঙ্গে একান্তে শহর বেড়ানোর কথা। কিন্তু সেই নস্ট্যালজিয়াও এবার মুছে যাওয়ার পথে। কারণ কলকাতা থেকে কার্যত উঠে যাচ্ছে ট্রাম।
দেশের একমাত্র শহর কলকাতা, যেখানে চলে ট্রাম। যা এবার কার্যত বন্ধ হওয়ার মুখে। করোনা কাল থেকেই শহরের একের পর এক রুটে বন্ধ হয়েছে এই পরিষেবা। আপাতত হাতেগোনা চারটি রুট বেঁচে আছে। এবার তাও মুছে যাওয়ার পথে। মডেল স্বরূপ মাত্র একটি রুটে জয়রাইড হিসাবে ট্রাম চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ধর্মতলা-ময়দানের মধ্যে তা চলাচল করবে। আদালতে সেকথা জানাবে রাজ্য। যানজট এবং দুর্ঘটনা এড়াতেই ট্রাম পরিষেবা তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত বলে সোমবার জানিয়েছেন রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী স্নেহাশিস চক্রবর্তী।
তিনি বলেন, “এসপ্লানেড থেকে ময়দান পর্যন্ত হেরিটেজ আকারে একটি সুসজ্জিত ট্রাম থাকবে। যাঁরা কলকাতায় আসবেন তাঁরা চাপবেন। হাই কোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা চলছে। কোর্টও জানতে চেয়েছে আমাদের সিদ্ধান্ত। তা আমরা জানাবে। জয়রাইড বাদ দিয়ে বাকি কোনও রুটে ট্রাম চলবে না। লাইনও তুলে ফেলব। রাস্তা বাড়েনি। গাড়ি বেড়েছে। তাই যানজট হচ্ছে। এভাবে ট্রাম চালানো অসম্ভব।” উল্লেখ্য, শহরে ট্রাম পরিষেবা চালু রাখার দাবিতে ক্যালকাটা ট্রাম ইউজার্স অ্যাসোসিয়েশনের তরফে হাই কোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা করা হয়েছিল। সেই মামলায় রাজ্যের সিদ্ধান্ত জানতে চায় আদালত।
সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে মুছে গিয়েছে অনেক কিছুই। শীতকালের গাছের পাতার মতো একে একে ঝরে যাচ্ছে কলকাতার নস্ট্যালজিয়াও। দোতলা বাস, টেলিগ্রাম, গ্যাস বেলুন, কাঠি আইসক্রিম কিংবা শালপাতায় মোড়া আলুকাবলি-ঘুঘনির ঠাঁই হয়েছে স্মৃতির হলুদ পাতায়। নিয়নের চকচকে আলোতে ক্রমশ ঝাপসা হয়েছে সেসব। তিলোত্তমার ইঁদুর দৌড়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে সময়ের দাবি মেনে এবার সরে যেতে হবে ট্রামকেও। ক্রমশ সময়ের গর্ভে বিলীন হবে সে।
তখন রাতে স্বপ্ন দেখা দূর, আর কেউ কল্পনাও করতে পারবে না, হ্যারিসন রোড-হাওড়া ব্রিজ ধরে ‘নড়িতে নড়িতে’ এগিয়ে চলেছে কলকাতা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.