সন্দীপ চক্রবর্তী: সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে বাম সরকার যে ‘ভুল’ করেছিল, তার পুনরাবৃত্তি চান না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম কয়লাখনি দেউচা-পাঁচামির ক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো করবে না তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকার। স্থানীয় মানুষের মতামত নিয়ে ও তাঁদেরকে এই প্রকল্পে যুক্ত করেই কাজ শুরু করতে চায় রাজ্য। মুখ্যসচিবের নেতৃত্বে কমিটি যেমন বিশেষজ্ঞ নিয়োগ-সহ উপযুক্ত সেরা সংস্থাকে দিয়ে কাজ করাবে, তেমনই স্থানীয় স্তরে তৈরি হওয়া কমিটি মানুষের সুবিধা, পরিষেবা ও প্রয়োজনীয়তার কথা খেয়াল রাখবে। এই কমিটিতে থাকবেন আদিবাসীদের প্রতিনিধিও। মুখ্যমন্ত্রী নিজেও কথা বলবেন। পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদের পাশাপাশি স্থানীয় নেতা-মন্ত্রীদেরও রাখা হবে জেলাশাসকের নেতৃত্বাধীন স্থানীয় কমিটিতে। মোদ্দা কথা, স্থানীয় স্তরে মানুষকে সঙ্গে নিয়ে আলোচনা করে, তবেই সিদ্ধান্ত নেবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
স্থানীয় মানুষজনকে পুনর্বাসন দেওয়ার পরে কাজ শুরু হবে প্রকল্পের। তাই পাঁচ বছর সময় ধরা হয়েছে। কয়েকদিন আগেই কেন্দ্রের চূড়ান্ত ছাড়পত্র ও অনুমোদন পেয়েছে রাজ্য সরকার। আগামী সপ্তাহে এনিয়ে মউ স্বাক্ষর হওয়ার কথা। তার আগে নবান্নে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকের পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্টই জানিয়ে দিলেন, “ঠিক করেছি, এখনই কাজ শুরু করব না। প্ল্যানিং ও ম্যাপ করা হবে। পুরোটাই সেরা লোকদের দিয়ে করানো হবে। তাড়াহুড়ো করে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে রাজি নই। যেন কোনও অভাব না হয়। সব দিক দেখে,তবেই প্রকল্পের কাজ শুরু করা হবে। লক্ষাধিক কর্মসংস্থান হবে।বীরভূম, পশ্চিম বর্ধমান তো বটেই, হুগলি, পশ্চিম মেদিনীপুর, পূর্ব বর্ধমান, বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার মানুষও ভীষণভাবে উপকৃত হবেন। কারিগরি প্রশিক্ষিত বা কম লেখাপড়া জানা মানুষ, আদিবাসী, সংখ্যালঘু, সাধারণ সম্প্রদায়ের মানুষ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবেন। এটা শপথ। পাঁচ বছরের কর্মযজ্ঞের পর কয়লাযজ্ঞ শুরু হবে।”
বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা কয়লাখনি প্রকল্পের ‘ক্ষমতা’ রাজ্যের হাতে থাকা নিয়ে গত তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে টালবাহানা চলছিল। অন্তত ছ’টি রাজ্য এই বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে। কেন্দ্রের কাছে বহুবার আরজি জানানো হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের তরফে। মুখ্যমন্ত্রী নিজে চিঠি লিখেছিলেন। দিন পনেরো আগে কয়লামন্ত্রকের চূড়ান্ত অনুমোদন আসে। কয়লাখনির কাজ শুরুর বিষয়ে সবুজ সংকেত দেয় কেন্দ্র। এরপর বৃহস্পতিবার মুখ্যমন্ত্রী নবান্নে বিভিন্ন দপ্তর ও জেলাস্তরের নেতা,আধিকারিকদের নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেন। সেখানে তিনি অভিযোগের সুরে বলেন, “অনেকে চায় না প্রকল্প হোক। ভুল বার্তা দেবেন না। বিশ্বের অর্থনীতিও বাংলাকে কেন্দ্র করে চালিত হবে।”
মুখ্যমন্ত্রী বুঝিয়েছেন, এই খনি থেকে উৎপাদন শুরু হলে আগামী ১০০ বছর পশ্চিমবঙ্গে আর কয়লার ঘাটতি হবে না। রাজ্য তো বটেই, দেশের জন্য প্রয়োজনীয় কয়লার জোগানও হবে এখান থেকেই। অভাব হবে না বিদ্যুতের। ২০১৫ সালে মোট ১৭টি কয়লা ব্লককে কেন্দ্রীয় কয়লা মন্ত্রকের তরফ থেকে বণ্টন করা হয়। যার মধ্যে দেউচা-পাঁচামি-হরিসিংহা-দেওয়ানগঞ্জ কয়লাখনিও রয়েছে। সেখানে ২১০২ মিলিয়ন টন কয়লা মজুত আছে বলে অনুমান করা হচ্ছে। প্রকল্পে পর্যায়ক্রমে মোট ১২ হাজার কোটি টাকা লগ্নি হবে বলে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন। প্রায় ১১,২২২ একর এলাকাজুড়ে অবস্থিত দেউচা-পাঁচামি কয়লা ব্লক এলাকায় প্রায় ৩৯৫টি পরিবারের বসবাস। এর মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ আদিবাসী। এই সমস্ত বাসিন্দাদের পুনর্বাসনের পরই সেখানে খনির কাজ শুরু হবে বলে আশ্বস্ত করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই বিষয়ে প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। এদিনের বৈঠকে মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব ও পুলিশ-প্রশাসন, সংশ্লিষ্ট দপ্তরের শীর্ষ কর্তারা যেমন ছিলেন, তেমনই ছিলেন শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্র, বিদ্যুৎমন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ও।
রাজ্যের মন্ত্রী ডঃ আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, চন্দ্রনাথ সিনহা ছাড়াও বীরভূমে তৈরি সরকারি কমিটিতে থাকা অনুব্রত মণ্ডল, বিকাশ রায়চৌধুরি, অভিজিৎ সিনহাকেও। মোট জমির প্রায় ২০০০ একর পরিত্যক্ত ও প্রায় ৯ হাজার একর জমি রায়তি। বনভূমির কিছুটা অংশ পড়বে। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের ছাড়পত্র দরকার। কেন্দ্রের কাছে জমা দিতে হবে ৫০ কোটি টাকা। মূলত এই কারণেই ১০০ কোটি টাকা দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের থেকে নেবে রাজ্য। পরে কেন্দ্র টাকা ফেরত দিলে ৫০ কোটি দেওয়া হবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.