ফাইল ছবি
সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: রাবণের চিতা- জঞ্জালের পাহাড় থেকে ওঠা ধিকিধিকি ধোঁয়া দেখে অনেকেই কটাক্ষ করে বলেন এ কথা৷ তবে এ চুল্লি কোনওদিনই নেভে না৷ কেননা জঞ্জালের শেষ নেই৷ আর তাই ধাপার আগুন চাপা থাকে না৷ শহরবাসীর কাছে এ অবশ্য নতুন কিছু নয়৷ তবে এই আগুন আর দূষণ কিন্তু নতুন তথ্য জোগাচ্ছে পরিবেশ কর্মীদের৷ জানা যাচ্ছে৷ ধাপা ও পাশ্ববর্তী অঞ্চলের মানুষদের গড় আয়ু কমছে ব্যাপক হারে৷ দূষণের বিষবাষ্পে মাত্র ৫০ বছরেই পৃথিবীর মায়া কাটাচ্ছেন বহু মানুষ৷
জজ্ঞাল জমা করতে ধাপার মাঠের জন্ম সেই ব্রিটিশ আমলে৷ ঔপনিবেশিক কলকাতায় শহর ঘুরে একটা জঞ্জালের ট্রেন গিয়ে সব আবর্জনা ফেলে আসত শহরের পূর্বপ্রান্তের এই ফাঁকা জায়গায়৷ শহরের সে চিত্র অবশ্য আমূল বদলে গিয়েছে এতদিনে৷ বেড়েছে জনবসতি৷ শহরের পূর্বপ্রান্তের এই অঞ্চল এখন রীতিমতো ঝাঁ চকচকে৷ কিন্তু চকচকে ত্বকে ব্রনর মতো আজও একই জায়গায় থেকে গিয়েছে ধাপা৷ বরং বেড়েছে আয়তন৷ বেড়েছে জঞ্জালের পরিমানও৷ প্রতিদিন প্রায় ৪ মেট্রিক টন জঞ্জাল এসে জমা হচ্ছে এখানে৷ গার্হস্থ্য জঞ্জাল থেকে মৃত পশুর দেহ- হেন জিনিস নেই যা এখানে পাওয়া যায় না৷
জজ্ঞাল ঘিরে রীতিমতো ব্যবসাও গড়ে উঠেছে এখানে৷ বর্জ্য প্লাস্টিক থেকে প্লাস্টিক রিসাইকেলের কারখানা তৈরি করেছেন স্থানীয় অধিবাসীরা৷ কেউ কেউবা আবার বেছে নিয়েছেন চাষাবাদ৷ শহরের মূল কেন্দ্রে সবজি সাপ্লাইয়ের অক্সিজেন যে ধাপার মাঠই অনেকটা জোগায়, তা শহরবাসীর অজানা নয়৷ কিন্তু এই বিপুল পরিমাণে জজ্ঞালের দূষণ, ধোঁয়া, জৈব গ্যাস সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষ মারাত্মক অসুখের মুখে পড়ছেন৷ সম্প্রতি এক সমীক্ষায় জানা যাচ্ছে, এর ফলে কমছে মানুষের গড় আয়ুও৷ এই এলাকায় যাঁরা কাজ করেন, কিংবা আশেপাশে যাঁরা বাস করেন ৫০-এর বেশি তাঁরা প্রায় কেউই বাঁচছেন না৷ ধোঁয়ার দূষণে মারাত্মক শ্বাসকষ্ট দেখা দিচ্ছে৷ এছাড়া কলেরা, যক্ষায় আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাও আকছার ঘটছে৷ জনস্বাস্থ্য নিয়ে যত সচেতনতাই প্রসার করা হোক না কেন, এই সমস্যা সমাধানে এক ধরনের উদাসীনতাই চোখে পড়ে৷ ফলে ধাপার বাসিন্দারা এটাকেই নিয়তি হিসেবে ধরে নিয়েছেন৷ অসুবিধা সত্ত্বেও এই ফাঁকা জায়গাকেই কয়েক হাজার মানুষ মাথা গোঁজার ঠাঁই হিসেবে বেছে নিয়েছেন৷ দুর্গন্ধে টেকা দায়, কিন্তু পেট বড় বালাই৷ তাই নোংরা ঘেঁটেই খাবার জোটাচ্ছেন তাঁরা৷ আর তাতে যদি আয়ু কমে, তবে যেন শাপে বর এই গরীব-গুর্বো মানুষগুলোর কাছে৷
ধাপা থেকে একটু দূরেই যে শহর গড়ে উঠেছে তা কিন্তু ঝাঁ চকচকে৷ যে কোনও বিদেশি শহরের সঙ্গে তার তুলনা করা যায়৷ শহরের এই দ্বৈত চিত্রটাই চোখে পড়ার মতো৷ একদিকে যখন উন্নয়ন নামক সোনার কাঠির তথাকথিত রূপকথা, অন্যদিকে ধাপা ও সংলগ্ন এলাকা যেন সে রূপকথার দুয়োরানি৷ সংস্কারের জন্য যে বিপুল পরিমাণে অর্থ লাগবে সেখানেই অসহায় হয়ে পড়ে প্রশাসন৷ ফলে কেন্দ্র-রাজ্য চেনা দোষারোপের পালা চলে৷ চলতেই থাকে৷ আর গড় আয়ু কমতে থাকে ধাপা এলাকার বাসিন্দাদের৷ দেশ ও রাজ্যকে স্বচ্ছ করে তোলার জন্য আলাদা আলাদা ক্যাম্পেনের আয়োজন হয়েছে৷ সোস্যাল মিডিয়ায় তা নিয়ে প্রচারের ঘটার অন্ত নেই৷ কিন্তু শহরের বুকেই যে ক্ষয়রোগ বাসা বেঁধে আছে সে নিয়ে যেন কোনও হুঁশ নেই সচেতন শহরের৷ এই দূষণ যে ব্যাপকভাবে বৃহত্তর শহরবাসীকেও প্রভাবিত করছে, বিশেষত আগামী প্রজন্মকে তা যেন জেনেও উদাসীন শিক্ষিত শহর৷ ফলে প্রতিদিনের মতো ধিকিধিক জ্বলছে রাবণের চুলো৷ আর তাতে শহরবাসী যে একদিন কোন চুলোয় যাবে, আপাতত তার কোনও উত্তর নেই৷ শুধু ধাপার জজ্ঞাল সরাতে সরাতে হতদরিদ্র অধিবাসীরা বলছেন, গরীবের আবার আয়ু৷ কাজ না করলে খাব কী৷ যত দূষণই ছড়াক কাজ তো করতে হবেই৷
কিন্তু এমন চলতে থাকলে দূষণে শহরই একদিন অকেজো হয়ে পড়বে না তো? জজ্ঞালের ধোঁয়া থেকে ওঠা এ প্রশ্নই মিশে যাচ্ছে সুস্থ শহরের বাতাসেও৷
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.