বিশেষ সংবাদদাতা: হিডকো কর্তৃপক্ষ জানে না, অথচ হিডকোরই কোটি কোটি টাকার জমি বিক্রি হয়ে গেল। এই মারাত্মক এবং বেনজির জমি কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠেছে নিউটাউনে। দুঃসাহসী এক প্রতারক চক্র হিডকোর নাম অপব্যবহার করে বিশিষ্ট ক্রেতাদের ভুল বুঝিয়ে জমি বিক্রি করেছে, আইডিবিআই ব্যাংকের কেষ্টপুর শাখায় টাকা জমা নিয়ে সে টাকা উধাও-ও করে দিয়েছে। এমনকী, জমির রেজিস্ট্রেশনও হয়ে গিয়েছে। শেষপর্যন্ত মিউটেশন পর্বে গিয়ে ধরা পড়েছে হিডকো এ ধরনের কোনও জমি বিক্রি করেনি। ফলে হইহই শুরু হয়েছে।
টেকনো সিটি থানায় এফআইআর দায়ের হলেও সে আর এক কেলেঙ্কারি। সূত্রের খবর, এই থানার আওতায় না কি বিতর্কিত কোনও জমিই পড়ছে না। শেষমেশ বিধাননগর কমিশনারেটের গোয়েন্দা পুলিশ তদন্তের দায়িত্ব হাতে নিয়েছে। সূত্রের খবর, হিডকোর জমির পাশাপাশি চক্রটি কেএমডিএ’র কিছু জমিও কোটি কোটি টাকায় বিক্রি করেছে বলে প্রাথমিকভাবে খবর আসছে। তদন্তকারীরাও প্রতারকদের দুঃসাহস দেখে বিস্মিত। যাঁরা টাকা দিয়ে বিপন্ন, তাঁরা মনে করছেন, মুখ্যমন্ত্রী হস্তক্ষেপ করলে বিষয়টির সুরাহা হবে, দোষীরা শাস্তি পাবে এবং তাঁরা টাকা ফেরত পাবেন।
নিউটাউনের কিছু প্রাইম লোকেশনে জমি বিক্রি আছে বলে নানা মহলে কিছুদিন আগে খবর আসে। প্রতারক চক্রটি অত্যন্ত সন্তর্পণে প্রচার করে, যেহেতু ‘লোভনীয়’ পজিশনে জমি, তাই প্রকাশ্যে টেন্ডার না করে গোপনে বিক্রি করা হবে। প্রভাবশালী ওই চক্রটি কলকাতার বেশ কিছু নামী সংস্থার শীর্ষকর্তাদের কাছে প্রস্তাব ‘অফার’ পৌঁছে দেয়। এখানেই শেষ নয়, প্রতারক চক্রের হোমওয়ার্কও ছিল দুর্দান্ত। কারণ, হিডকোর প্রাইম লোকেশনে থাকা কোন জমি এখনও ফাঁকা আছে, সেগুলি তালিকাভুক্ত করেই ক্রেতাদের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছিল তারা। কেএমডিএ’র জমি বিক্রির ক্ষেত্রেও একই ভাবে তালিকা বানিয়েছে বলে তদন্তকারীদের কাছে খবর। গোয়েন্দাদের দাবি, হিডকো এবং কেএমডিএ’র জমি বণ্টন বিভাগে ওই চক্রটির গভীর যোগাযোগ না থাকলে কোনওমতেই এই তালিকা তৈরি করা সম্ভব নয়। তাই চক্রের পাণ্ডাদের সঙ্গে যুক্তদেরও গ্রেপ্তারের দাবি উঠেছে। তদন্তকারী গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, হিডকোর শীর্ষকর্তাদের অজ্ঞাতেই এমন জমি কেলেঙ্কারি ঘটেছে।
প্রশ্ন উঠেছে, প্রশাসনের নাকের ডগায় হিডকোর নাম ভাঙিয়ে ডুপ্লিকেট নথি বানিয়ে কয়েক একর জমি বিক্রি করা এই দুঃসাহসিক চক্র কীভাবে এত বড় অপরাধ করতে পারল? প্রাইম লোকেশনে বহু মূল্যবান জমি বিক্রির মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে যুক্ত হতে একবারও বুক কাঁপল না? বিশেষ করে মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত ছাড়া যেখানে এক ছটাকও জমি বিক্রি হয় না, সেখানে কীভাবে এত বিপুল পরিমাণ জমি নিঃশব্দে একাধিক সংস্থাকে রেজিস্ট্রি করে দেওয়া হল? প্রাথমিক তদন্তে তিনজন অপরাধীকে গোয়েন্দারা চিহ্নিত করলেও বুধবার পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। প্রতারক চক্রে জড়িত অন্যদের সন্ধানে বিধাননগরের গোয়েন্দারা অভিযান শুরু করেছেন। পুলিশের কাছে এখনও পর্যন্ত পাঁচজন ক্রেতা অভিযোগ করেছেন। কিন্তু, হিডকোর নামে আইডিবিআই-এর কেষ্টপুর ব্রাঞ্চে রেজিস্ট্রির সময় যে টাকা জমা পড়েছিল, তা পরদিনই অন্য অন্য অ্যাকাউন্টে সরিয়ে নেওয়ায় বিপুল পরিমাণ অর্থের সন্ধান মেলেনি। অবশ্য ক্রেতাদের আস্থা রয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর উপর। তাঁরা বলছেন, বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রীর নজরে এলেই অপরাধীরা শাস্তি পাবে, টাকাও ফেরত পাওয়া যাবে।
প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে, ক্রেতাদের কাছে বিক্রির সময় হিডকোর অধীনে থাকা নির্দিষ্ট জমির যে সমস্ত নথি প্রয়োজন তা হুবহু নকল করেছিল প্রতারক চক্র। বস্তুত, সেই কারণে জমি রেজিস্ট্রেশনের সময় রেজিস্ট্রারও বুঝতে পারেননি যে হিডকো নয়, ভুয়া নথি দিয়ে প্রতারকরা বিক্রি করছে। এখানেই শেষ নয়, জমি সার্চ করতে গিয়ে নথিতে দাগ-খতিয়ানসহ যে সমস্ত তথ্য ও লোগো থাকা দরকার তা ক্রেতাদের সরবরাহ করা কাগজপত্রেও রেখেছিল প্রতারকরা। স্বভাবতই ক্রেতারা ধরতেই পারেননি ভুয়া নথিতে জমি কিনছেন ও কোটি কোটি টাকা আইডিবিআই ব্যাংকের ভুয়ো অ্যাকাউন্টে চলে যাচ্ছে।
তাৎপর্যপূর্ণ হল, ওই জমি বিক্রির জন্য নির্ধারিত হারে স্ট্যাম্প ডিউটি বাবদ কয়েক কোটি টাকা রাজ্য সরকারের রাজস্ব বিভাগে জমা পড়ে গিয়েছে। নিয়ম মেনে জমি কেনার পর ক্রেতারা মিউটেশন করতে গেলে জমি কেলেঙ্কারি ধরা পড়ে। কারণ, নিয়ম মেনে বিক্রেতা ও ক্রেতা দু’তরফকেই নোটিস করা হয় মিউটেশনের সময়। দু’পক্ষের সম্মতি পেলেই তবেই মিউটেশন দেয় ভূমি ও রাজস্ব দফতর। এক্ষেত্রে নোটিস পেয়ে হিডকো জানিয়ে দেয়, তারা এই প্রাইম জমিগুলির কোনওটিই বিক্রি করেনি। কোটি কোটি টাকা দিয়ে সম্পত্তি কেনা ক্রেতাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে ছোটেন হিডকো দফতরে। আধিকারিকরা জানিয়ে দেন, সরকারি জমি এভাবে বিক্রি হয় না। এর পরেই তড়িঘড়ি পরিস্থিতি সামাল দিতে টেকনো সিটি থানায় এফআইআর করা হয়। কিন্তু, বিতর্কিত জমিগুলির একটিও এই থানার অধীনে নয়। প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে কি গোটা বিষয়টি ধামাচাপা দিতে অন্য থানায় ইচ্ছা করেই অভিযোগ করা হয়েছে? এর পর অবশ্য বিধাননগর কমিশনারেটের হাতে তদন্তের ভার পড়েছে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.