কৃষ্ণকুমার দাস: স্পেনে সরকারি সফরে গিয়ে মেসেজে পুজোর থিম শুনেছিলেন তিনি। তারপর মাত্র ১ ঘণ্টা ৫৭ মিনিটে সেখান বসেই গান লিখে, সুর দিয়ে, নিজেই গেয়ে পাঠিয়ে দেন। মহালয়ার বিকেলে মুখ্যমন্ত্রীর পুজো উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে সুরুচি সংঘের থিম সঙের গীতিকার ও সুরকার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) এমন বিশেষ সৃজনী ক্ষমতার তথ্য ফাঁস করলেন রাজ্যের বিদ্যুৎ ও ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস।
‘মা’ শব্দটি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমস্ত কর্মসূচি ও কর্মযজ্ঞ জুড়ে থাকে। আর অন্য বছরের মতো এবারও সুরুচির থিম সঙ ‘মা, তোর একই অঙ্গে এত রূপ’ গানের কথা ও সুরও দিয়েছেন তিনি। গানটি গেয়েছে তৃষা পারুই। অন্যবছর পুজো উদ্বোধনে সশরীর এসে দীর্ঘক্ষণ সুরুচিতে কাটান মুখ্যমন্ত্রী। ‘আপনার সশরীর উপস্থিতি ছাড়া সুরুচির পুজো হয় না’ বলে শনিবার আবেগরুদ্ধ হয়ে পড়েন অরূপ। চোখের কোনা চিক চিক করে ওঠে। অবশ্য তখুনি সামলে দেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। বলেন, ‘‘ভাবিস না, ঠিক দেখা হবে কার্নিভালে।’’
এরপরই মমতা বাংলার লোকশিল্প-হস্তশিল্প-কুটিরশিল্প, তিনের সুষম সমন্বয়ে তৈরি মণ্ডপ দেখতে চান সুরুচির সভাপতি ও মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের কাছে। সঙ্গে সঙ্গে অরূপ বলেন, ‘‘দিদি, এবছর বাংলার নানা জেলার লোকশিল্প, হস্তশিল্পের মধ্যে যে বর্ণময় বৈচিত্র রয়েছে তা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। প্রায় তিনমাস ধরে কাজ করেছেন গ্রামবাংলার শতাধিক গুণী হস্তশিল্পী।’’
সুরুচির এবছরের পুজো মণ্ডপটিও মায়ের অবয়ব। বাঁশ-বেত, গুলঞ্চ লতা, কাপড়-সুতো দিয়ে তৈরি গ্রামবাংলার জনপ্রিয় ঢ্যাপা পুতুল প্রতিমা দর্শনার্থীদের ফেসবুকে কলকাতার পুজোয় ভাইরাল হতে বাধ্য। মণ্ডপে ঢোকার মুখেই আপনাকে স্বাগত জানাবে বাঁকুড়ার পাঁচমুড়ার বিশালাকার বর্ণময় টেরাকোটা ঘোড়া, বর্ধমানের নতুন গ্রামের কাঠের পুতুল, বীরভূমের চদর বদর শিল্প। মণ্ডপসজ্জায় ব্যবহৃত হয়েছে পুরুলিয়ার আউশ ধানের শীষ, সবং গ্রামের খাগড়াকাঠি, উত্তর ২৪ পরগনার মাছ ধরার পলো। দেওয়ালে ভিতরে শোলা ও লতার নানা উপকরণে শ্বেতশুভ্র অজস্র মালার খেলা। ঢোকরা ধাঁচের তাম্রবর্ণের সনাতনী মাতৃপ্রতিমা দেখতে ঢুকেই প্রতিমা দর্শনার্থীদের চোখ চলে যাবে মণ্ডপের ছাদে। কাপড় কেটে কেটে তৈরি নানা রঙের পটচিত্র ও পুরুলিয়ার জুন ঘাসে বোনা ঝাড়বাতি ও ঝাড়গ্রামের পাঁচি গামছার শিল্পসৌকর্যে বিস্ময়াবিষ্ট হবেনই দর্শকরা।
তাৎপর্যপূর্ণ হল, কাপড়ে সুতোর বুননে মুগ্ধ করা ‘সিলুয়েট’ শিল্পসৃষ্টিতে ফুটে উঠেছে নেতাজি, রবীন্দ্রনাথ, সত্যজিৎ রায়, মহানায়ক উত্তম কুমার থেকে বাউল ও ছৌশিল্প। শিল্পী গৌরাঙ্গ কুইলা শুধু মণ্ডপ নয়, সাবেকী মুখের ধাতব প্রতিমার বসনে চিরন্তন অলংকরণে ফুটে ওঠা রবীন্দ্রনাথের সহজ পাঠ বয়স্ক দর্শকদের শৈশবকে মনে করিয়ে দেবে। মূর্তির ডানদিকে দু’টি বিশাল তালপাতার পাখা ‘মা’-কে হাওয়া দিচ্ছে।
বনেদিয়ানার এমন পুরাতনী দৃশ্য দেখে মুগ্ধ মুখ্যমন্ত্রী অরূপের উদ্দেশে বলেন, ‘‘শহরে পুজো দেখতে আসা বিদেশি পর্যটক ও ইউনেসকোর প্রতিনিধিরা এলে এই তালপাতার পাখায় হাওয়া দেবে। মাটির ভাঁড়ে চা খাওয়াবে। বাইরের পুতুলগুলি ও প্রতিমা সংরক্ষণ করবে। পুজো হয়ে গেলে আমায় দুটো পাখা দিয়ে যাবে।’’ মণ্ডপ থেকে বাইরে এলেই সার দিয়ে দাঁড়ানো আদিবাসীদের মূর্তি। অভিনবত্ব হল, মূর্তিগুলির হাত নড়ছে গানের তালে তালে। সুরুচির এবারের আরেক বার্তা, প্লাস্টিক বর্জন। একথা জানিয়ে অরূপের দাবি, ‘‘কম বাজেটে পরিবেশবান্ধব প্রাকৃতিক সামগ্রীতে তৈরি মণ্ডপে বাংলার হস্তশিল্পীদের শ্রেষ্ঠত্বকে প্রকাশ করেছে।’’
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.