গৌতম ব্রহ্ম: ছিল ‘লাং অ্যাডিনো কার্সিনোমা’। হয়ে গেল ‘স্মল সেল লাং ক্যানসার’। জিনের পরিবর্তনে রোগীর দেহে রূপান্তরিত হচ্ছে ক্যানসারও (Cancer)। মারণ রোগের এই গিরগিটির মতো রং বদলের প্রবণতাকে সামনে এনে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নিঃশব্দ বিপ্লব ঘটালেন এক বঙ্গতনয়া। বুঝিয়ে দিলেন, ওষুধ যতই ধারাল হবে, ক্যানসার হয়ে উঠবে ততই ধুরন্ধর। অতএব, ক্যানসার চিকিৎসায় অভিন্ন থেরাপি দেওয়া যাবে না। ব্যক্তিবিশেষে বদল আনতে হবে চিকিৎসায়, ওষুধে।
ড. ত্রিপর্ণা সেন (Dr Triparna Sen)। নিউ ইয়র্কের মাউন্ট সাইনাই হসপিটালের সহযোগী অধ্যাপক ও লাং ক্যানসার পিডিএক্স প্রোগ্রামের উপ-অধিকর্তা এখন কলকাতায়। ক্যানসার গবেষণার এক সেমিনারে এসে বক্তৃতাও দিলেন। তার আগে ‘সংবাদ প্রতিদিন’-কে একান্ত সাক্ষাৎকারে জানালেন তাঁর গবেষণার খুঁটিনাটি, কলকাতায় ফিরে কাজ করার ইচ্ছে। ত্রিপর্ণার বাবা অঙ্কোলজিস্ট। ছোট থেকেই বাবাকে এই মারণ রোগের বিরুদ্ধে লড়তে দেখেছেন। বহু প্রিয়জনকে কেড়ে নিয়েছে ক্যানসার। সেই থেকেই এই মারণ রোগ নিয়ে গবেষণার ইচ্ছে ডালপালা মেলেছে ত্রিপর্ণার মনে। রাজাবাজার থেকে জেনেটিক্স নিয়ে মাস্টার্স করা মেয়েটি বরাবর চাইতেন, তাঁর গবেষণা সরাসরি প্রয়োগ হোক ক্যানসার চিকিৎসায়। রোগীকল্যাণে হয়ে উঠুক বিশল্যকরণী। এই লক্ষ্যেই ল্যাবের সঙ্গে ক্লিনিককে যুক্ত করে চলেছে তাঁর ‘ট্রান্সেশ্লনাল’ গবেষণা। আমেরিকার এমডি অ্যান্ডারসনে প্রথম সেই সুযোগ মেলে। তাঁর গেম চেঞ্জিং গবেষণা বহু জার্নালে প্রকাশিত হয়। ত্রিপর্ণার পর্যবেক্ষণ, ক্যানসার নিজের রূপ বদলায় বলেই এই বিপত্তি, ওষুধের এহেন নিষ্ক্রিয়তা।
২০২১ সালে এই বিষয় নিয়ে তাঁর গবেষণাপত্র সবার নজর কাড়ে। যেখানে উল্লেখ রয়েছে, লাং অ্যাডিনো কার্সিনোমায় ‘ওসিমার্টিনিভ’ নামে এক ধরনের ওষুধ ব্যবহার হয়। প্রথমদিকে ভাল কাজও করলেও পরে আর ওষুধটি কাজ করে না। এক্ষেত্রে জিনের মিউটেশন ঘটিয়ে ‘লাং অ্যাডিনো কার্সিনোমা’ বদলে হচ্ছে ‘স্মল সেল লাং ক্যানসার’ (SCLC)। আসলে ক্যানসার নিজেকে বাঁচাবার জন্য বারবার রূপবদল করে। এই ‘শেপ শিফ্টিং ক্যানসার’ই ত্রিপর্ণার গবেষণার মূল বিষয়। চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল ক্যানসার ইনস্টিটিউট থেকে পিএইচডি করা তরুণী জানালেন, “হলুদ, গাজর, ক্যাপসিকাম, রসুন, গ্রিন টি ক্যানসার রোধে দারুণ কার্যকর। দিদা-ঠাকুরমাদের রেঁধে খাওয়ানো অনেক পদেই কর্কট বধের ফর্মূলা মজুত। হেঁসেলে মজুত অনেক মশলাতেই, তা সে জিরে হোক বা ধনে, তাতে ক্যানসার ঠেকানোর অ্যাক্টিভ ইনগ্রেডিয়েন্ট মজুত। যেমন হলুদে রয়েছে কারকুমিন, গ্রিন টি-তে ইজিসিজি (EGCG)। আয়ুর্বেদেও বহু ভেষজের উল্লেখ রয়েছে, যেগুলি ক্যানসার প্রতিরোধে সক্ষম। সেগুলি নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে আছে। ত্রিপর্ণার প্রেসক্রিপশন, “কেমোথেরাপির মতো চিকিৎসা ক্যানসার কমাতে সাাহায্য করে ঠিকই, কিন্তু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও যে অনেক। সেক্ষেত্রে পথ্যই যদি ওষুধ হয়ে ওঠে, তাহলে সব দিক বাঁচে। তাছাড়া একটা পর্যায়ের পর ক্যানসার রোগীর উপর আর ওষুধ প্রয়োগ করা যায় না। এই নিয়ে বড় করে গবেষণার প্রয়োজন।”
সম্প্রতি, বিশ্ববন্দিত ন্যাচার কমিউনিকেশন জার্নালেও এসসিএলসি নিয়ে ত্রিপর্ণার একটি পেপার প্রকাশিত হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, লাং ক্যানসার খুব দ্রুত রূপবদল করে স্মল সেল লাং ক্যানসারে রূপান্তরিত হয়। গোটা শরীরে ছড়িয়ে যায়। ফলে, অস্ত্রোপচারের সুযোগ থাকে না। ‘সার্জিকাল’ নমুনা পাওয়া যায় না বলে এই ক্যানসারের ‘প্রি ক্লিনিক্যাল মডেল’ তৈরি করাও মুশকিল। এই পরিস্থিতিতে ত্রিপর্ণার ‘সেনস ল্যাব’ ৩৩ রোগীর থেকে নমুনা নিয়ে ৪৬ মাউস মডেল তৈরি করে চিকিৎসাবিজ্ঞানকে উপহার দিয়েছে। যা নতুন ওষুধ আবিষ্কারে বড় ভূমিকা নেবে বলেই মনে করা হচ্ছে। এসসিএলসি অ্যাটলাস তৈরি থেকে ওষুধের অসহায়তা সবেতেই রয়েছে বাংলার নারীশক্তির অবদান।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.