আজ যে পদ্মে ,কাল সে ঘাসফুলে। কে জানে কে কখন কোন দলে? রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে ২০২১ বছরটা ছিল এইরকমই ভূরি ভূরি দলবদলের। কখনও ‘মানুষের স্বার্থে’ কখনও ‘দম নেওয়ার’ চেষ্টায় নীতি নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে দল বদলেছেন বহু নেতা। আর শুধু নেতাই বা কেন হবে, রাজনীতির বাইরে বেরিয়ে খেলাধুলো বা অন্যান্য ক্ষেত্রেও হয়েছে বহু দলবদল। বছরশেষে সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ঘুরে দেখল সেই দলবদলের কাহিনি।
মুকুল রায়: ‘ঘর ওয়াপসি’ হয়তো একেই বলে। চারবছর আগে তিনি নেত্রীর উপর ‘অভিমান’ করে যোগ দিয়েছিলেন বিজেপিতে। তাঁকে কেন্দ্র করেই একসময় বাংলা দখলের স্বপ্নে বিভোর হয়েছিল গেরুয়া শিবির। বিজেপির সেই স্বপ্ন একুশের ভোটে চুরমার। মুকুল রায়ও (Mukul Roy) বিজেপিতে থাকতে পারলেন না আর। অভিমান ভুলে ফের ঢলে পড়লেন ঘাসফুলে। চলতি বছরে জুন মাসে চার বছর বাদে তৃণমূলে প্রত্যাবর্তন হল মুকুলের। সম্পূর্ণ হল বৃত্ত। তবে, মুকুলবাবুর রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে এখনও ধন্দ রয়েছে।
বাবুল সুপ্রিয়: দলবদলের তালিকায় এই নাম চমকে দেওয়ার মতোই। আসলে খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির (Narendra Modi) ঘনিষ্ঠ বৃত্তে থাকা বাবুল সুপ্রিয় যে বিজেপি নেতৃত্বের উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে এভাবে দলবদল করে বসবেন, সেটা একপ্রকার অভাবনীয় ছিল। কিন্তু ২০২১ সালে সেই অভাবনীয় কাণ্ডটিই ঘটেছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়ার পর প্রথমে বাবুল (Babul Supriyo) রাজনীতি থেকে সন্ন্যাস নেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। জানিয়ে দেন, ফের গানবাজনায় মন দিতে চান। কিন্তু রাজনীতির টান থেকে বেশিদিন নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেননি আসানসোলের প্রাক্তন সাংসদ। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি হঠাৎই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে তৃণমূলে নাম লিখিয়ে ফেলেন তিনি।
রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়: দলবদলের বাজারে সবচেয়ে ‘নজরকাড়া’ যদি কেউ থেকে থাকেন, তিনি রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় (Rajib Banerjee)। বছরের শুরুতে তিনি ছিলেন তৃণমূলে। ভোটের মুখে একপ্রকার চমকপ্রদভাবে তিনি চলে যান বিজেপিতে। বিধানসভা থেকে ইস্তফা দিয়ে বেরোনোর সময় রাজীববাবু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) একটি ছবি সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন। জানিয়ে দিয়েছিলেন, মমতাকে মায়ের মতোই শ্রদ্ধা করেন। চাটার্ড বিমানে করে দিল্লিতে নিয়ে গিয়ে রাজ্যের প্রাক্তন বনমন্ত্রীকে দলে যোগদান করায় বিজেপি (BJP)। কিন্তু আখেরে লাভ কিছুই হয়নি। রাজীব নিজে ডোমজুড়ে হেরেছেন। কোনও প্রার্থীকে জেতাতেও পারেননি। ভোটের পর আবার তৃণমূলে প্রত্যাবর্তন করেন তিনি। এবার ত্রিপুরায় গিয়ে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে তৃণমূলের পতাকা হাতে নেন রাজীব।
রুদ্রনীল: একসময় ছিলেন বামপন্থী। রাজ্যে পালাবদলের পর বাম থেকে ডানে আসেন অভিনেতা রুদ্রনীল ঘোষ (Rudranil Ghosh)। নাম লেখান তৃণমূলে। একটা সময় শাসকদলের শীর্ষনেতাদের ঘনিষ্ঠও ছিলেন। কিন্তু ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনের আগে রুদ্র ফের রংবদল করেন। রাজ্য সরকারের বিভিন্ন নীতির বিরোধিতা করে নাম লিখিয়ে নেন গেরুয়া শিবিরে।
হিরণ চট্টোপাধ্যায়: টলিউডের এই প্রজন্মের অভিনেতাদের মধ্যে তাঁর নেতা হওয়ার প্রবণতা বেশ লক্ষণীয়। কিন্তু সফলভাবে যাঁরা এই কাজটি করতে পেরেছেন, তাঁদের মধ্যে একজন হলেন অভিনেতা হিরণ (Hiran Chatterjee)। একটা সময় তিনি ছিলেন তৃণমূলে। বিধানসভা ভোটের কিছুদিন আগে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে (BJP) নাম লেখান হিরণ। খড়গপুর সদর থেকে বিধায়কও হন। যদিও বিধায়ক হিরণের সঙ্গে এখন দলের সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি তথা মেদিনীপুরের সাংসদ দিলীপ ঘোষের (Dilip Ghosh) সম্পর্ক আদায়-কাঁচকলায়।
শ্রাবন্তী চট্টোপাধ্যায়: একটা সময় তিনি ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুগামী। কিন্তু চেষ্টা করেও ঢুকতে পারেননি মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বৃত্তে। তাই শেষপর্যন্ত ২০২১ বিধানসভা ভোটের আগে শ্রাবন্তী (Srabanti Chatterjee) যোগ দেন বিজেপিতে। কিন্তু গেরুয়া শিবিরের আর পাঁচজন তারকার মতো বিধানসভা ভোটের লড়াইয়ে পরাস্ত হন। তারপর থেকেই ফের তৃণমূল মুখো শ্রাবন্তী। কিছুদিন আগে শাসকদলের এক সভায় গিয়ে গানও গেয়েছেন তিনি।
অমরিন্দর সিং: বছরশেষে জাতীয় রাজনীতিতে সবচেয়ে চর্চিত দলবদল! একসময়ের পাঞ্জাব কংগ্রেসের ক্যাপ্টেন আজ দলছাড়া হয়ে আলাদা রাজনৈতিক দল খুলেছেন। জোট করছেন বিজেপির সঙ্গে। ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিংয়ের (Amarinder Singh) নেতৃত্বে ২০১৭ সালে পাঞ্জাবে ক্ষমতায় আসে কংগ্রেস। কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই সিধুর (Navjot Singh Sidhu) সঙ্গে বিবাদের জেরে মুখ্যমন্ত্রিত্ব এবং দল দুটোই ছাড়তে হয় তাঁকে। আপাতত পাঞ্জাব লোক কংগ্রেস নামের নতুন দল খুলে কংগ্রেসকে হারানোর চেষ্টা করছেন ক্যাপ্টেন।
কানহাইয়া কুমার: চলতি বছরের জাতীয় রাজনীতিতে সবচেয়ে চর্চিত দলবদল সম্ভবত এটাই। যে কানহাইয়া কুমারকে (Kanhaiya Kumar) সামনে রেখে দেশের রাজনীতিতে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছিল বামেরা, সেই কানহাইয়া কুমারই বামেদের ছেড়ে রাহুল গান্ধীর ‘হাত’ ধরলেন। বামেদের একসময়ের ‘পোস্টার বয়’ যোগ দিয়ে দিলেন কংগ্রেসে। শুধু তাই নয়, দলবদলের সময় পার্টি অফিস থেকে খুলে নিয়ে গেলেন নিজের লাগানো এসিটিও। ভাবা যায়!
লিওনেল মেসি: দল কি শুধু রাজনীতিবিদরাই বদলান? খেলোয়াড়রাও তো বদলান। যেমন এবছর বদলে ফেললেন লিওনেল মেসি (Leo Messi)। ছোটবেলার ক্লাব বার্সেলোনা ছেড়ে মেসি এবছর নাম লিখিয়েছেন পিএসজিতে। যদিও মেসি নিজে দল বদলাতে চাইছিলেন না। কম বেতন নিয়েও বার্সেলোনাতেই থেকে যেতে চেয়েছিলেন লিও। কিন্তু ক্লাবের আর্থিক অবস্থা এতটাই খারাপ যে, মেসিকে কম বেতনেও রাখতে পারেনি বার্সা। অগত্যা প্যারিস সাঁ জাঁ-তে যোগ দেন লিও।
ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো: মেসি একা নন। এবছর দল বদলেছেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোও (Cristiano Ronaldo)। মেসি ছোটবেলার প্রিয় ক্লাব ছেড়ে চলে গিয়েছেন অন্য ক্লাবে। রোনাল্ডো আবার অন্য ক্লাব থেকে কামব্যাক করেছেন প্রিয় ক্লাব ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডে। ইটালির জুভেন্তাস থেকে ঘরে ফিরেছেন ঘরের ছেলে।
কারণ বা ফলাফল যাই হোক, ২০২১ সালের এই ভুরি ভুরি দলবদল অনেক কিছু স্থায়ীভাবে বদলে দিয়ে গেল। একদিকে যেমন রাজনীতির ময়দানে নেতাদের দলবদল সাধারণ মানুষের মনে রাজনীতির প্রতি বিতৃষ্ণা আরও বাড়িয়েছে, অন্যদিকে তেমনই খেলার মাঠের দলবদল বিভ্রান্ত করেছে ক্রীড়াপ্রেমীদের। দুই ক্ষেত্রেই সংশয়, কাকে ছেড়ে কাকে সমর্থন করব?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.