বয়স আশির কোঠা পেরিয়েছে তিন বছর আগেই। চেহারায় তার ছাপ পড়েছে। তবু ফিটনেসে এখনও তিনি তেত্রিশের মতোই টগবগে, চাঙ্গা। কোন জাদুবলে? বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান (Left Front) বিমান বসুর সঙ্গে কথা বললেন বুদ্ধদেব সেনগুপ্ত।
প্রশ্ন: শারীরিক সক্ষমতায় ও মানসিকভাবে তিরাশিতেও তেত্রিশ। রহস্যটা কী?
উত্তর: একজন মানুষের তিরাশি বছর বয়সে যেমন শারীরিক গঠন হতে পারে আমিও তাই। চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রেও যে পরিবর্তন হয়নি তা বলতে পারব না। তবে এর মধ্যে রহস্য কিছু নেই। আমি মনে করি বয়সের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি মানুষকে তার শরীরের উপর নজর দেওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে খাওয়া দাওয়ার ক্ষেত্রে। বয়স বাড়লে রোগ, জ্বালা ও যন্ত্রণা বাড়ে। তাই পরিমিত খাওয়া-দাওয়া করতে হয়। যে কোনও খাবার দেখতে সুন্দর ও সুস্বাদু হলেই শরীরের পক্ষে ভাল হবে, এমনটা নয়। তাই লোভ সংবরণ করতে হবে। সেইসঙ্গে প্রতিদিন নিয়ম করে শরীরচর্চাও জরুরি। আমিও করার চেষ্টা করি। ব্যস্ততার মধ্যে রুটিনে এদিক-ওদিক হলে পরে তা পুষিয়ে নিই।
প্রশ্ন: পরিমিত খাওয়া-দাওয়ার কথা বলছেন। সেটা কেমন। নিজে কেমন করে তা করেন?
উত্তর: এই জীবনে আমার কপালে বোধহয় আর ভাত জুটবে না। ভাত আমি মুখে তুলি না। দিন শুরু করি কাঁচা হলুদ আর নিমপাতা দিয়ে। সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে নিমপাতা আর কাঁচা হলুদ চিবিয়ে খাই। পার্টি অফিসে যে নিমগাছ আছে সেখান থেকেই পাতা পেয়ে যাই। তারপর প্রাতরাশে একেকদিন একেকরকম খাবার খাই। আজ যেমন বিহারের মানুষের পছন্দের দুটো লিট্টি খেয়েছি। সঙ্গে যে চাটনি দিয়েছিল, খুব ঝাল ছিল। তাই একটা মিষ্টি খেয়েছি। কোনওদিন দুটো ইডলি বা উপমা থাকে। তারপর কয়েক গ্লাস লিকার চা। অবশ্যই চিনি ছাড়া। দুপুর তিনটে নাগাদ মধ্যাহ্নভোজে একটি ফল। বিশেষ করে শসা আর আপেল। তারপর থেকে রাত পর্যন্ত আবার কয় গ্লাস লিকার চা। তবে বেশিরভাগ সময় আমি চা ঠান্ডা করে খাই।
প্রশ্ন: রাতে কিছু খান না?
উত্তর: রাতে তো একটু খেতেই হবে। নইলে অনেকটা সময় খালি পেটে থাকতে হয়। তবে আমি রাতে তেতো খাই। মা-ঠাকুমারা বলতেন, রাতে তেতো খেতে নেই। কিন্তু আমি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি,রাতে তেতো খাওয়ার মধ্যে অবৈজ্ঞানিক কিছু নেই। তাই নিয়ম করে উচ্ছে ভাজা অথবা শুক্তো খাই। সঙ্গে এক বাটি ডাল আর দুটো রুটি। আর এক টুকরো মাছভাজা। নিরামিষাশী হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু চিকিৎসকদের পরামর্শে এক পিস মাছ খেতেই হয়। শরীরে অ্যানিম্যাল প্রোটিনের জন্য। এই হচ্ছে আমার সারাদিনের খাবার।
প্রশ্ন: (দু’জনের জন্য চা আসার পর) আমাকে যে চা খাওয়াচ্ছেন তা তো বেশ দামি মনে হচ্ছে?
উত্তর: চায়ের প্রতি আমার একটু ‘ফ্যাসিনেশন’ আছে। যখন বাড়ি ছাড়লাম তখন আমার বেতন ছিল ১১০ টাকা। পি সুন্দরাইয়া আমার ওয়েজ বেঁধে দিয়েছিলেন। তখনও আমি ১০০ টাকা দামের চা খেতাম। ১০০ গ্রাম চা হলেই আমার সারা মাস চলে যেত। বাকি টাকায় সারা মাসের খাওয়া-দাওয়া ও অন্যান্য খরচা চালিয়ে নিতাম।
প্রশ্ন: সারাদিনে এত কম খান, আপনার খিদে পায় না?
উত্তর: আমার শরীরে যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকুই তো খাব। প্রয়োজনের তুলনায় বেশি খেলে শরীর খারাপ করবে। প্রথম দিকে একটু অসুবিধা হলেও বহু বছর আর হয় না।
প্রশ্ন: সুস্থ থাকার জন্য শরীরচর্চা করেন?
উত্তর: আগে যোগব্যয়াম করতাম। একবার বিদেশে গিয়ে সেখানকার চ্যানেল দেখে যোগব্যায়াম শিখেছিলাম। বিদেশের চ্যানেলগুলো শরীর সুস্থ রাখার জন্য অনেক রকম অনুষ্ঠান দেখায়। যেটা সাধারণত আমাদের দেশে নেই। এখানে একজন চিকিৎসক আমি সঠিকভাবে যোগব্যায়াম করছি কিনা তা দেখেন। পরে বলে সব ঠিক আছে আপনি চালিয়ে যেতে পারেন।
প্রশ্ন: এখনও এই বয়সেও যোগব্যয়াম চালিয়ে যাচ্ছেন?
উত্তর: স্লিপ ডিস্ক হওয়ার পর চিকিৎসকরা যোগ ব্যায়াম বন্ধ করতে বলেছিলেন। তাই এখন করি না। তার বদলে সিঁড়ি ভাঙি। প্রতিদিন নিয়ম করে একতলা থেকে চারতলা অনেক বার করে ওঠানামা করি। সেইসঙ্গে ফ্রি হ্যান্ড।
প্রশ্ন: এত ব্যস্ততার মধ্যে প্রতিদিন নিয়ম করে করতে পারেন?
উত্তর: কোনওদিন না করতে পারলে পরে পুষিয়ে নিই। সেদিন একটু বেশি করে হাঁটাচলা করি।
প্রশ্ন: কোনও ওষুধ খেতে হয়?
উত্তর: একটা প্রেশারের ওষুধ খেতে হয়। এ ছাড়া যদি কখনও শরীর খারাপ করে তখন চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খাই।
প্রশ্ন: সুস্থ থাকার জন্য নতুন বছরে কিছু টিপস দেবেন?
উত্তর: বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিমিত আহার করতে হবে। এর জন্য লোভ সংবরণ জরুরি। যার যেমন শারীরিক সক্ষমতা, তাকে ততটাই শরীরচর্চা করতে হবে। যাঁদের হাঁটুতে বা কোমরে সমস্যা নেই, তাঁরা সিঁড়ি ভাঙুন। লিফট ব্যবহার করবেন না। আমি করি না। কখনও পাঁচতারা হোটেলে যেতে হলে আমি সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠি। অনেকে অবাক হয়। কিন্তু শরীরের কথা মনে করে এটাই করতে হয়।
প্রশ্ন: এই বয়সে মিছিলে এত হাঁটেন কী করে? রহস্যটা কী?
উত্তর: আমার হাঁটুতে বা পায়ে কোনও সমস্যা নেই। কোমরে একটা সমস্যা থাকলেও তাতে বিশেষ অসুবিধা হয় না। ওই যে বললাম প্রতিদিন অনেক সিঁড়ি ভাঙি। একতলা থেকে চারতলা ওঠানামা করি। শ্বাস-প্রশ্বাসেও আমার কোনও সমস্যা নেই। ধূমপান করি। এখন বয়স বেড়েছে, তাই বেশি হাঁটলে হাঁফ ধরে যায়। ইদানীং দমে একটু ঘাটতি হচ্ছে। তুমি শরীরের সঙ্গে যেমন ব্যবহার করবে, শরীরও তোমাকে তেমন ব্যবহার ফিরিয়ে দেবে।
প্রশ্ন: তা হলে ধূমপান বন্ধ করছেন না কেন?
উত্তর: জীবনে অনেক কিছুই ছেড়েছি। ৩১ বছর বয়সে বাড়ি ছেড়ে পার্টি অফিসে এসে উঠেছি। খাওয়াদাওয়ার তালিকা থেকে অনেক কিছু বাদ দিয়েছি। খুব পরিচিত না হলে কোনও বিয়েবাড়ি বা নেমন্তন্ন বাড়ি আমি যাই না। ভাইফোঁটা নেওয়া ছেড়েছি। তাই চা আর সিগারেট হয়তো এই জীবনে ছাড়তে পারব না। চিকিৎসকরা বলেছেন ছাড়তে। কিন্তু তাঁদের কথাও শুনিনি।
প্রশ্ন: আপনি সেলফি তুলতে পছন্দ করেন না। কেন?
উত্তর: আমি মনে করি, যারা সেলফি তোলে তারা ‘সেলফিশ’।
প্রশ্ন: সম্প্রতি আগরতলায় বিজন ধরের স্মরণসভা এবং রামপুরহাটে বীরভূম জেলা সম্মেলনে অনেকের মোবাইল ভেঙে দিয়েছেন। কেন ভাঙলেন? পরে খারাপ লাগেনি?
উত্তর: ‘সেলফিশ’ লোকেদের সঙ্গে ছবি তুলতে নেই। আর আমি যার ছবি তুলছি তার জন্য অনুমতি নিতে হয়। এরা কেউই আমার অনুমতি নেয়নি। আর খারাপ লাগার কথা বলছ। যে এই কাজটা করছে, সে তো খারাপ কাজ করছে। খারাপ লোকেদের সঙ্গে ‘নো কম্প্রোমাইজ’। আর যখন মোবাইল ছিল না তখনও ছবি তোলা হত। আমিও তো মোবাইল ব্যবহার করি না। তার পরও তো আমার জীবন চলে যাচ্ছে।
প্রশ্ন: জীবনে কোন কোন ঘটনা আপনাকে কষ্ট দেয়?
উত্তর: মাকে আমি খুব ভালবাসতাম। তার জন্যই কমিউনিস্ট পার্টিতে আসা। সেই মাকেই আমি নাকি জন্মের সময় খুব কষ্ট দিয়েছিলাম। পরিবারের বড়দের মুখে শুনেছি। আমি যখন গর্ভে, পূর্ববঙ্গ থেকে মাকে নিয়ে বাবা স্টিমারে গোয়ালন্দ হয়ে ট্রেনে কলকাতা এসেছিলেন। শুনেছি, স্টিমারযাত্রায় মায়ের রক্তক্ষরণ হয়। ট্রেনে উঠে রক্ত বন্ধ হয়। কলকাতায় এসে তখনকার ক্যাম্পবেল হাসপাতালের নামী ডাক্তার নীলরতন সরকারের কাছে বাবা লিখে পাঠিয়েছিলেন মাকে পরীক্ষা করাতে। প্রসবের সময় আর পাঁচটা শিশুর মতো আমার মাথা আগে বেরোয়নি, বেরিয়েছিল পা। আর কষ্ট পেয়েছিলাম সেই মাকেই যখন ছেড়ে পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হলাম। বাড়ি ছাড়লাম।
প্রশ্ন: ’১১ সালে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার দিন কষ্ট হয়নি?
উত্তর: কষ্ট যে হয়নি তা বলব না। কিন্তু পার্টি যখন ক্ষমতায় ছিল না সেই সময়টাও তো আমি দেখেছি। তাই আমাকে খুব বেশি যন্ত্রণা দিতে পারেনি। বরং শূন্য হয়ে যাওয়াটা বেশি যন্ত্রণা দিয়েছে। কিন্তু এখনও বিশ্বাস করি মানুষের সঙ্গে থাকতে হবে। পার্টিতে নতুন যাঁরা আসছে, তাঁদের এটা বারবার বলি। মানুষের বিপদে পাশে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। তবেই তোমাদের মানুষ বিশ্বাস করবে।
প্রশ্ন: বাড়ি ছাড়ার পর কোথায় উঠলেন? মাথা গোঁজার ঠাঁই কি আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন?
উত্তর: না। বেনিয়াপুকুরে কৃষকসভার অফিসে এসে উঠলাম। কৃষকসভার পুরনো অফিস তখন ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ওদের রান্নাঘরে ঠাঁই হল আমার। রান্নাঘরের তাকে বই রাখতাম। আর অফিসের টয়লেটটা ব্যবহার করতাম। পরে প্রমোদ দাশগুপ্ত যে ঘরে থাকতেন সেখানে জায়গা হল। আর অনিল বিশ্বাসের সময় থেকেই আলিমুদ্দিন স্ট্রিট আমার ঘরবাড়ি আর সংসার।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.