তরুণকান্তি দাস: মুশকো চেহারাটার কোমরে জোড়া গামছার প্যাঁচ৷ লুঙিটা মালকোঁচা মারার ব্যর্থ চেষ্টা৷ পুরনো কেতার বাবু-গেঞ্জিটার রং কোনও এক সময় সাদা ছিল নিশ্চিত৷ সস্তার রোদ-ঝড়-জলের ভরসা রবারের চটিতে হাঁ-মুখ৷ গঙ্গাপাড়ে কুমোরটুলির এই রং ভরা শরতের পাড়ায় বড়ই বেমানান৷ কিন্তু পেট বড় দায়৷ সে কবে মানানসই জীবনের ধার ধেরেছে? মালবাহী উটের কাঁধে যেমন ঘষা খাওয়া চামড়া কালো এবং পুরু তেমনই এই মানবজমিনের ওই অংশটুকুর অনুভূতিশক্তি প্রায় লুপ্ত৷ তা বলে মন? এই ষষ্ঠীর ঢাঁই-কুড়কুড় বাদ্যি কোনও ঢেউ তোলে না হৃদমাঝারে? কানে গোঁজা বিড়িটা পেড়ে ফেলে ফস করে আগুন দেয় কোঁকড়াচুল৷ সেই আগুনে তাঁর মুখখানি কেমন যেন দেখায়৷ কেমন? আলোভাসি শহরের সব অন্ধকার যখন পাশের গঙ্গার ভাটায় যেন সমুদ্রমুখী, তখন এই তল্লাটে তাঁর মুখে যেন আলকাতরার পোঁচ৷ সেই কালো মোছার জাদু জানেন মা?
“ধুস!” বলেই অর্ধসমাপ্ত বিড়িটা ছুড়ে ফেলে সেই মুখ৷ ‘‘মা বড়লোকের’’, মেজাজখান বড় তিরিক্ষি গো৷ শরীরে যেন মুগুর পেটানো ব্যথা৷ “সবাই কুমোরটুলির কথা বলে৷ আমরা ছাড়া মা মণ্ডপে যাবেন? পয়সা ফেলার বেলায় যত্ত ন্যাকড়াবাজি৷” মদনপুর থেকে উজিয়ে কলকাতা৷ এ শহর কাউকে ফেরায় না৷ ফেরায়নি তাঁকেও৷ অর্জুন পোদ্দার৷ নাম ও পদবিটা তো চমকে দেওয়ার মতো৷ তা কদ্দিনের জন্য এ পাড়ায়? অবাক তাকান কলিযুগের ‘তৃতীয় পাণ্ডব’৷ ‘‘মা কালীকে জলে ফেলি৷ তবেই না ছুটি৷’’ কীভাবে? কাজটা কী? “কেন কাঁধ ভাড়া৷” সে কী! কোনও অভিধানে এমন পেশা আছে নাকি?
বিলক্ষণ আছে৷ পেশার চেয়ে কিছু নেশা কখনও বড় হয়ে দাঁড়ায়৷ অর্জুনদের কাছেও হয়তো তাই৷ না হলে ফি বছর ঘুরে ঘুরে আসা৷ এখানে৷ সঙ্গে মাধব, নন্টে, রবীন এবং আরও অনেকে৷ টিম মদনপুর! যেন কোনও ফুটবল ম্যাচ খেলতে হাজির৷ পঞ্চমীর নিশিতেও এই পাড়ায় এদের ছুটি নেই৷ ট্রামলাইন যেখানে সামান্য বেঁকেছে, সেখান থেকে কুমোরপাড়া দেখা যায়৷ গত ক’দিন যুদ্ধ লড়ে আপাত ক্লান্ত অবসন্ন দেহখান এলিয়ে দেওয়া৷ বিছানা মানে, কেয়ার অফ ফুটপাথ, খোলা আকাশ৷ আগে-পিছে, ডাইনে-বাঁয়ে, উপর পানে আনন্দ-আলোর ছটায় সেই আকাশের তারারা হারিয়ে যায়৷ মাঝ শুক্লপক্ষের চাঁদও যেন কত দূরের৷ ক্লাবের কর্তা ও অতি উৎসাহী ছেলে-ছোকরাদের হই হই রই রই ছিল ক’টা দিন৷ ডালাখোলা লরি নিয়ে এই মহল্লায় ঢুকে পড়া৷ যুদ্ধ জয়ের ভঙ্গিতে সশস্ত্র মাকে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়া৷ তার পর ছিল বনেদি, বড় বাড়ির বাবুদের আনাগোনা৷ তাঁদের চিকন মেজাজ৷ সোনালি ফ্রেমের চশমার ফাঁক দিয়ে প্রতিমা, শিল্পের চুলচেরা ‘কত জানি’ বিচার৷ এবং নিজের রুচির উপর অগাধ আস্থা রেখে পকেটের মাপমতো সপরিবার মহামায়াকে নিয়ে বাড়ির পথ ধরা৷ তবে মা তো এদের কারও কাঁধে চেপে মণ্ডপে পৌঁছান না৷ তবে? মায়ের জন্য কাঁধ ভাড়া দিতে সন্তানের অভাব আছে নাকি? ফ্যালো কড়ি, মাকে তোলো, আমি কি তোমার পর? একেবারেই না৷ বরং আয়োজকদের তুলনায় এই সন্তানদের কসরত, ঘাম ঝরানো দেখে ত্রিনয়নী উমাও হয়তো অবাক হন৷ আর তাঁদের ঘরে কাঁদেন মা, গর্ভধারিনী৷ মেয়ে, বউ জানে পার্বতী আসছেন বলেই আর ক’দিন পরে নতুন জামা হবে৷ দরদ ভরে নতুন তাঁতের শাড়ির গন্ধ নিয়ে ঘরে ঢুকবে মরদ৷ যাক না বয়ে নবমী নিশি৷ এই ঘরে যেদিন জামা-শাড়ি, সেদিন উৎসব! অর্জুনের মতো রবীনের হাতে কড়া পড়েছে৷ জোর লাগাকে হেঁইসা..৷ কাঁধ ফুলে ঢোল৷ যেন হাপু খেলার আঁকিবুকি এ দেহে৷ পায়ের তলায় যে কত ক্ষত৷ ‘‘কখনও কাঠামোর পেরেক ঢুকে যায়৷ কখনও বাঁশের টুকরো৷ মাকে কাঁধে তুলছি আর তখনই পায়ের উপর ক্লাবের ছেলেদের বুটের চাপ৷ লরির ডালায় ধাক্কা৷ ‘বাপ বাপ’ করে ককিয়ে উঠলেও, চোখের জল ঘামে মিশলেও কিছু করার নেই৷ কিচ্ছুটি না৷ চুপ৷ মা উঠবেন লরিতে, গন্তব্য বাপের বাড়ি৷ হাত ফস্কালেই বিপদ৷ উত্তেজিত ছেলেপিলের গনপিটুনিতে থেকে বাবা ভোলানাথও রক্ষা করতে পারবেন না৷” বলেন মাধব৷ মণ্ডপে প্রতিমা পৌঁছে দিয়ে তবে রেহাই এবং অপেক্ষা৷ পাশেই আর এক দল পা ছড়িয়ে বসে৷ টিম ক্যানিং৷ কেউ আলুর হিমঘরে কাজ করেন, কেউ বড়বাজারের গদির বস্তা টানেন বছরভর৷ প্রতীক্ষা কিসের? বাড়ি ফেরার? ‘‘না না৷ দশমীর৷ মাকে গঙ্গায় দিয়ে আসতেও তো এই কাঁধ ভরসা৷”
পরিবার? কেন কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী৷ সর্বোপরি মহামায়া৷ এবং ভোলেবাবা৷ আমরা তো ওই পরিবারের অঙ্গ৷ ওদের অক্ষত রাখার দায়িত্ব যে আমাদেরই কাঁধে৷” অঙ্গরক্ষক? হাসেন অর্জুন৷ রুটির সঙ্গে ভাঁড়ে সবজি, উঁকি মারে নিউট্রিলা৷ মুখে তুলতে তুলতে বলেন, ‘‘অঙ্গের হাল তো দেখলেন৷ রাখে মা মারে কে?’’
লুঙির ট্যাঁকে উঁকি মারে বাৎসরিক বড় পার্বণের ছোট কামাই৷ কাঁধের ভাড়া৷ শিউলির গন্ধ ছাই৷ এখানে, গঙ্গার পাড়ে কোনও কাশফুলের বন নেই৷
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.