Advertisement
Advertisement

Breaking News

Buddhadeb Bhattacharjee

আবেগের অভিঘাতে স্বেচ্ছাবন্দি! বুদ্ধবাবুর স্মৃতিচারণায় কুণাল ঘোষ

কীসের অভিমান ছিল প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর?

Kunal Ghosh remembers Buddhadeb Bhattacharjee after his death
Published by: Paramita Paul
  • Posted:August 9, 2024 11:46 am
  • Updated:August 9, 2024 2:38 pm  

কুণাল ঘোষ: অস্তাচলে এক অভিমানী। কিংবা অভিমানীর অবসান।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর চিরবিদায়কে এই শব্দবন্ধনী দিয়ে অনুভব করতে চাইলে কি ভুল হবে? বোধহয় না।
অসুস্থ, ক্রমশ আরও অসুস্থ, পুরোপুরি ঘরবন্দি। ২০১১-র পরিবর্তন অর্থাৎ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর কিছুকাল সক্রিয় রাজনীতিতে। তার পরেই গুটিয়ে, ভয়ানকভাবে গুটিয়ে।

কীসের অভিমান?
এক, তাঁর নিজের পার্টি সিপিএমের একটা বড় অংশের বিরুদ্ধে, যাঁরা গোষ্ঠীবিন‌্যাসে তাঁকে সমর্থন করেননি। দুই, বামফ্রন্টের শরিক দলগুলির বিরুদ্ধে, যাঁদের বড় অংশ মনেপ্রাণে পরিবর্তনের যুদ্ধে বুদ্ধবাবুর পতন চেয়েছিলেন। তিন, বামফ্রন্ট বহির্ভূত বাম শক্তিগুলির বিরুদ্ধে, যাঁরা কৃষিজমির ইস্যুতে বিরোধীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। চার, একশ্রেণির বুদ্ধিজীবীর বিরুদ্ধে, যাঁরা প্রায় প্রতি সন্ধ‌েয় নন্দনে তাঁর দর্শনপ্রার্থী হতেন, কিন্তু সন্ধিক্ষণে বিরোধীনেত্রীর অনুরাগী হয়ে ‘পরিবর্তন চাই’ হোর্ডিংয়েও দৃশ‌্যমান হয়েছিলেন। পাঁচ, যাদবপুরে, তাঁর নিজের নির্বাচনী কেন্দ্রের মানুষের বিরুদ্ধে, যাঁরা তাঁকে প্রাক্তন মুখ‌্যমন্ত্রীর পাশাপাশি প্রাক্তন বিধায়কেও পরিণত করে দিয়েছিলেন। ছয়, বাংলার আমজনতার বিরুদ্ধে, যাঁরা তাঁর ভাবনা বা প্রয়োগকৌশলে সাড়া না দিয়ে বিরোধিতা করেছিলেন। সাত, আমজনতার বিরুদ্ধে, যাঁরা জমি আন্দোলনে গণহত‌্যার পর তাঁর ছবিতে লাল রং লাগিয়ে ঘাতকের অভিযোগ তুলেছিলেন, তার মধ্যেও ছিলেন বামঘরানার লোকজন।

Advertisement

[আরও পড়ুন: মেনুতে মৌরলা-ইলিশ, কুমড়ো ফুলের বড়া! ‘খাদ্যরসিক’ বুদ্ধবাবুকে স্মরণ পুরুলিয়ার পাচকের]

বিচিত্র এবং বিরল মানসিকতা ছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর। নেতা, অথচ মূলত তাত্ত্বিক, সংগঠন এবং তৃণমূলস্তর থেকে দূরে। নেতা, অথচ দিনের একটা বড় সময় তিনি দিতেন সাহিত‌্য-সংস্কৃতির চর্চায়। নেতা, অথচ ভাবতেন সঠিক লক্ষ্য, কিন্তু সেই লক্ষ্যে পৌঁছনোর বাস্তবোচিত রণকৌশল তাঁর আয়ত্তে ছিল না। নেতা, সততা যাঁর মুকুট, উদ্ভট জেদ এবং ঔদ্ধত‌্য সেই মুকুটের কাঁটা। নেতা, যিনি তাঁর পার্টির রক্ষণশীল বা ডাইনোসর যুগের নীতি বা কর্মসূচি থেকে সরে সময়োপযোগী করতে চান, অথচ নিজের সেই পার্টির নেতা বা শ্রমিক-কৃষক সংগঠনকে বোঝানোর ক্ষমতাই তাঁর নেই। মাথার উপর জ্যোতি বসু, পার্টি ধারকবাহক বিমান বসু, অনিল বিশ্বাসদের মোড়কে বুদ্ধবাবুর যে যতিচিহ্নগুলি ঢাকা পড়ে বাক‌্য থাকত মসৃণ, মূলত অনিল বিশ্বাসের প্রয়াণের পর আলিমুদ্দিন স্ট্রিট বনাম মহাকরণের টানাপোড়েনে সেগুলিই ক্রমশ চিরস্থায়ী দাঁড়িতে পরিণত হয়েছিল।

সাংবাদিকতার দীর্ঘ পথে, বুদ্ধদেববাবুকে কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতায় আমি নিশ্চিত, যে অদৃশ‌্য আবহটাকে তিনি ক্ষমতার আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ বলে মনে করেছিলেন, যা দিয়ে রাতারাতি বদলে দেবেন অনেক কিছু, যখন দেখলেন প্রদীপের সেই দৈত‌্য আসলে চিরাচরিত সিস্টেমের বাহন যা তাঁর নিজের পার্টিকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে, তখন নিজের মস্তিষ্ক এবং হৃদয়ে বিস্ময়াঘাতের যে বিচ্ছুরণ তিনি অনুভব করেছেন, তাতে অভিমানী না হয়ে উপায় কী ছিল? তিনি অনেকাংশেই ছিলেন ঔদ্ধত‌্য, দম্ভের পূজারী। ছিলেন উচ্চগ্রামের আবেগের আধার। তাই প্রবল গতিতে চলা তাঁর ভাবনা যখন নিজেরই চৌকাঠে হোঁচট খায়, তখন ক্ষতবিক্ষত মন ততটাই গভীর অভিমানী হবে, এটা স্বাভাবিক।

সাংবাদিক হিসাবে বুদ্ধবাবুর বেশ কিছু নীতি এবং পদক্ষেপের সমালোচনা করেছি। রাজনীতির মঞ্চে দাঁড়িয়েও তীব্র বিরোধিতা করেছি তাঁর কিছু সংলাপ ও কর্মসূচির। তবু, অকপটে বলি, সাংবাদিক হিসাবে বার বার তাঁর কাছ থেকে যে স্নেহ, প্রশ্রয়, সহযোগিতা পেয়েছি, তাতেই মন ভরা থাকবে স্মৃতিসুধায়। তিনি জানতেন আমি সিপিএমপন্থী নই, তিনি জানতেন আমি মমতা বন্দ্যোপাধ‌্যায়ের আন্দোলনের ঘরানার সমর্থক, তবু যেভাবে সাহায‌্য করেছেন, ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এও বারবার সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, দেশে-বিদেশে একাধিক সফরে সঙ্গে যেতে দিয়েছেন, তাতে ধন‌্যবাদই দিতে হয়।

[আরও পড়ুন: হাসিনা অতীত, বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে শপথ নোবেলজয়ী ইউনুসের]

মানুষ হিসাবে আকর্ষণীয় ব‌্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। গল্প করার মেজাজে থাকলে অসাধারণ। সাহিত্যের অনুবাদের জন্য যখন কলম ধরতেন, তখন দেখেছি জন্ম নিচ্ছে ‘এই আমি মায়াকোভস্কি’। নাটক, সংস্কৃতিতে সাবলীল বিচরণ। আবৃত্তির কণ্ঠ এবং ভঙ্গি অতুলনীয়। আবার মন্ত্রী, মুখ‌্যমন্ত্রী এমনকী দলের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস‌্য হিসাবেও সাংগঠনিক বা প্রশাসনিক কাজের মূল‌্যায়নে তাঁকে সফল বলা কঠিন। একাধিক ইস্যুতে জট পাকিয়ে ফেলেছেন ঘরে-বাইরে। কিছুটা স্ববিরোধিতাও ছিল। জ্যোতিবাবুর মন্ত্রিসভায় ইস্তফার কয়েকটা দিন বাদ দিলে তিনি দীর্ঘদিনের মন্ত্রী, নীরবে পার্টির সব ‘ভুল’ কাজ সমর্থন করলেন, কার্যকর করলেন। আর যেদিন নিজে মুখ‌্যমন্ত্রী হলেন, তখনই যেন এক পালটে যাওয়ার বার্তা, ‘এতদিন সব ভুল হচ্ছিল, আমি নতুন করে সাজাব।’ রাতারাতি এই ইমেজ বদলের রসায়নটা হজম করতে পারেনি সিপিএমের একাংশ, সিটু, কৃষকসভা, বাম শরিকরা।

বুদ্ধবাবুকে স্বপ্নের সওদাগর করে মিডিয়া যত ব‌্যক্তিপুজোয় ইমেজ বিল্ডিং করেছে, তত তিনি আরও বেশি করে সরে গিয়েছেন সিপিএমের শিকড় থেকে। ফলে শিল্পের স্বপ্ন দেখিয়ে তিনি যুবসমাজের একাংশকে অনুরাগী করে তুলতে পেরেছেন, আবার শিল্প তৈরির জন‌্য কৃষিজমি দখল করতে গিয়ে একদিকে যেমন কৃষক সমাজকে দূরে ঠেলে দিয়েছেন, পাশাপাশি টাটার সঙ্গে চুক্তি সই করে সিটুর চোখে শ্রেণিচ্যুত হয়েছেন। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্ব শুরুর থেকেই যত সময় এগিয়েছে, মুখ‌্যমন্ত্রী পদে থেকেছেন তিনি, কিন্তু সরকারের লাগাম যেন হাত থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। গোটা রাজ‌্য-রাজনীতির ভরকেন্দ্র হয়ে গিয়েছিলেন তৃণমূলনেত্রী। ‘আমিত্ব’ নিয়ে ব‌্যস্ত থাকা ‘ভদ্রলোক’টি ঢুকে পড়েছিলেন চক্রব‌্যূহে, যেখান থেকে বেরনোর রণকৌশল জানার মতো মাটির রাজনীতি যিনি কোনওকালেই করেননি। কিন্তু এই ভুলভুলাইয়ার মধ্যেও ‘আমি আমার মতো’ নীতিতে স্বতন্ত্র তিনি, হয়তো সগর্বে, সজেদে। একদিকে যখন নিজের গোঁ ধরে কমিউনিস্ট পার্টির নীতিগত শিকড়ে টান মেরে সময়োপযোগী প্রগতির রূপকথা শোনাচ্ছেন, অন‌্যদিকে তখনই জীবনযাত্রায় এতটুকু মেদ জমতে না দিয়ে পাম অ‌্যাভিনিউয়ের সেই ছোট ফ্ল‌্যাটে, একান্ত কমিউনিস্ট সুলভ ঔদ্ধত্যে প্রত‌্যাখ‌্যান করেছেন ভারত সরকারের দেওয়া পদ্মভূষণ।

তাঁর প্রয়াণে তীব্র শোকের আবহ। টিভি, কাগজ, ফেসবুক, এক্স হ‌্যান্ডল, বিভিন্ন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ সংবাদ, স্মৃতিচারণ, বিশ্লেষণ, মন্তব্যে ব‌্যস্ত, সেটা স্বাভাবিক। কৌতূহল, এত লোক যদি ২০১১-তে বুদ্ধবাবুকে সমর্থন করতেন, তাহলে সিপিএমও বিদায় নিত না, বুদ্ধবাবুকেও যাদবপুরে হারতে হত না। মৃত্যুর পর বিতর্ক থাকে কম, বন্দনা হয় বেশি। এখানেও সেটা হচ্ছে এবং হবে। অথচ সেদিনের পরাজয়টা ছিল বাস্তব। এই বাস্তবের ধাক্কাটা মেনে নিতে পারেননি বুদ্ধবাবু। মমতা বন্দ্যোপাধ‌্যায়ের নেতৃত্বে নতুন সরকার শপথ নেওয়ার ১২ দিনের মাথায় ধর্মতলায় জনসভায় বলেছিলেন, “আমরা সব নজর রাখব।” প্রাথমিক সেই প্রতিক্রিয়া কালের নিয়মে গভীর অভিমানের অতলে তলিয়ে গিয়েছে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর প্রয়াণ মানে সিপিএম রাজনীতির শেষ মহীরুহের পতন। বিমান বসু আছেন, প্রার্থনা করব আরও অনেকদিন থাকুন। সুস্থ থাকুন। কিন্তু বুদ্ধবাবু পার্টি এবং সরকার মিলিয়ে নিজেকে আরও বেশি আলোচ‌্য করে তুলতে পেরেছিলেন।

সিপিএম সেই ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর থেকে বলে চলেছে ভুল সংশোধনের কাজ চলছে। পার্টি শূন্য হয়ে গেল, তবু সেই সংশোধনের প্রক্রিয়া শেষ হল না। উল্টে সিনিয়ররা যখন এক কঠিন লড়াই লড়ছেন দিশাহীন নীতিভ্রান্তিতে, নতুনরা এক অদ্ভুত ঔদ্ধত্যের ভাইরাসে সংক্রমিত হচ্ছেন। এই সিপিএম যদি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর অভিমানকে বাস্তবসম্মত মান‌্যতা দিয়ে তার প্রকৃত কারণগুলো চিহ্নিত করে, তাহলে ব‌্যর্থতার কারণ খুঁজতে আর বৈঠকের পর বৈঠক, রাজ‌্য কমিটি থেকে পলিটব্যুরো তত্ত্বকথার ঝুলি নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করতে হবে না। কেন কার্যত স্বেচ্ছাবন্দি ছিলেন বুদ্ধবাবু, কেন গুটিয়ে রেখেছিলেন নিজেকে, রাখঢাক না করে চর্চা করুক সিপিএম।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement