অর্ণব আইচ: নতুন বছরের প্রথম দিনে সন্তানদের সঙ্গে পুঁটিকেও নিয়েই ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছেন তার ‘মা’। কারণ, হাজরার মিঠু পালের কাছে যে সন্তানসমই কুঁড়িয়ে পাওয়া লক্ষ্মীপ্যাঁচা পুঁটি। সেই কারণেই এলাকাবাসীর কাছে তিনি ‘প্যাঁচার মা।’
নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও এখনও কিছু লোক লুকিয়ে বাড়িতে টিয়া, চন্দনা, ময়না পোষে। কিন্তু দক্ষিণ কলকাতার হাজরা মোড়ের মিঠু পাল সেসবের ধারকাছ দিয়েও যান না। তাঁর পোষ্য আস্ত একটি লক্ষ্মীপ্যাঁচার শাবক। কাকে ঠোকরানো প্যাঁচাটিই এখন তাঁর ধ্যানজ্ঞান। সারাদিন যত না কাজকর্মের পিছনে, এমনকী ছেলে আর মেয়েদের দিকেও সময় দেন, তাঁর চেয়েও এখন যুবতীটির বেশি নজর তাঁর পোষা প্যাঁচাটির দিকে। ইতিমধ্যেই এলাকার বাসিন্দারা তাঁকে ‘প্যাঁচার মা’ বলে ডাকতে শুরু করেছেন। তাতে রাগ করা দূরে থাক, রীতিমতো খুশি এই যুবতী। কেউ প্যাঁচা পুষছেন, এমন দৃশ্য কলকাতায় বিরল। তা-ও আবার রাস্তার উপর। মিঠু শুনেছেন, প্যাঁচা বিশেষ পোষ মানে না। কিন্তু মিঠুর প্যাঁচা যে তাঁর কাছ ছেড়ে নড়তেই চাইছে না।
দিন কয়েক আগে হঠাৎই কা-কা ডাক শুনে মেট্রো স্টেশনের দেওয়ালের দিকে তাকান মিঠু। দেখেন, কয়েকটি কাক একটি প্রাণীকে ক্রমাগত ঠুকরে চলেছে। তিনি কাকগুলিকে তাড়া করে সরিয়ে দিতেই দেখেন একটি লক্ষ্মীপ্যাঁচার শাবক। প্যাঁচা ধরা উচিত কি না, ভাবতে ভাবতেই তিনি তার খুব কাছে যান। প্যাঁচার শাবকটিও তাঁর কাপড়ের মধ্যে আশ্রয় খোঁজে। তিনি শাবকটিকে তুলে নিয়ে আসেন তাঁর ঝুপড়িতে। প্রথমে মনে করেছিলেন, অন্ধকার নামলেই উড়ে যাবে রাতচরা পাখিটি। কিন্তু তিনি দেখেন, উড়ে পালানোর প্রবণতা আর পাখিটির নেই। বরং সে মানুষের আশ্রয়েই নিজেকে নিরাপদ বলে মনে করছে। মিঠু জানান, যেহেতু লক্ষ্মীপ্যাঁচা, তাই সংস্কারবশত সেটিকে কাছেই একটি মন্দিরে নিয়ে যান। তার নামকরণ করেন ‘পুঁটি’।
এবার সমস্যা দাঁড়ায়, পাখিটি খাবে কী? তিনি শুনেছিলেন, লক্ষ্মীপ্যাঁচা আমিষ খায়। শিকার করে ইঁদুর, ব্যাং। তাই ছোট মাছ, মাংসের টুকরো, মেটে সব রকম খাবারই পাখিটির সামনে তিনি রাখেন। কিন্তু কোনও কিছুতেই যে মুখ দিচ্ছে না তাঁর আদরের পুঁটি। তিনি খাওয়ানোর চেষ্টা করলেও খাচ্ছে না। কী ভেবে আলুসেদ্ধ আর ভাত মেখে খাওয়ানোর চেষ্টা করলেন। দিব্যি খেয়ে নিল সেটি। এর পর তিনি কলা চটকে খাওয়াতে শুরু করলেন। তা-ও খেয়ে নিল পুঁটি। ছাতুতেও আপত্তি নেই প্যাঁচা শাবকটির। তাই পুঁটির জন্য ডজনখানেক কলা কিনে এনেছেন। পুঁটির মধ্যাহ্নভোজনের সময় তাকে রীতিমতো কোলে নিয়ে বসেন মিঠু। একটি মানব শিশুর মতোই তাকে হাঁ করিয়ে কলা চটকে গলায় ঢুকিয়ে দেন। মাঝে মাঝে মানব শিশুর মতোই খেতে চায় না। তখন একটু জোর করেই মাতৃস্নেহে রীতিমতো আদুরে গল্প করতে করতে তার মুখে খাবার ঢুকিয়ে দেন। গিয়ে নেয় পুঁটি। চলে ফের তাকে খাওয়ানোর পালা। খাওয়ানোর পর প্যাঁচাটির ঠোঁটটিও ধুইয়ে দেন তিনি।
মিঠুর মতে, পুঁটি তাঁর বড়দিনের উপহার। ফুটপাথবাসী এই যুুবতী কাগজ কুড়িয়ে সংসার চালান। এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। পুঁটিকে তিনি তৃতীয় সন্তান বলতে শুরু করেছেন। পুঁটিকে ছেড়ে কাজেও বিশেষ বের হতে পারছেন না। তাই রাতচরা পাখিটিকে নিয়ে নতুন বছরের প্রথম দিনেই বেড়াতে বের হতে চান। এমনকী, পুঁটিকে নিয়ে বর্ষবরণের রাতে মজা করতেও অসুবিধা নেই তাঁর। কারণ, রাতেই যে সে বেশি ভাল দেখতে পায়। মিঠু জানেন, হয়তো বন দপ্তর খবর পেলে তাঁর আদরের পুঁটিকে নিয়ে যাবে। পরে সে যেখানেই থাক, তার ‘মানুষ মা’কে যে কোনওদিনও ভুলবে না, সেই বিশ্বাস রয়েছে মিঠুর।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.