সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: সংস্কৃতির শহর৷ কবিতা-শিল্প-সিনেমার শহর, রবীন্দ্রনাথ-বিবেকানন্দর শহর৷ কলকাতার মুকুটে এমন কত না সোনালি পালক অহরহ পরানো হয়ে থাকে৷ কিন্তু বাস্তবটা? না, সত্যিটা বুঝি এতটাও রঙিন নয় আর৷ কেননা এ কলকাতার মধ্যে আছে আর একটা কলকাতা, যেখানে স্রেফ ড্রাইভার সঙ্গে থাকার কারণে এক মহিলাকে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয় অভিজাত রেস্তোঁরায়৷
শুনতে অবাক লাগলেও কর্পোরেট জমানার ঝাঁ-চকচকে কলকাতায় এভাবেই যেন বদলে গিয়েছে তথাকথিত সভ্য হয়ে ওঠার মাপকাঠি৷ ঘুরে গিয়েছে মানবিকতা ও ভদ্রতার হাওয়ামোরগ৷ কে বলবে এ শহরেরই এক মানুষ আচণ্ডাল ভারতবাসীকে নিজের ভাই হিসেবে ভাবতে প্রাণিত করেছিলেন! কলকাতাবাসীর ঐতিহ্যেই যেন আঘাত হেনেছে জনৈক দিলাশি হেমনানির তোলা অভিযোগ৷ সোশ্যাল মিডিয়ায় এক পোস্টে তিনি জানিয়েছেন, কলকাতায় এক অভিজাত রেস্তোরাঁর কর্মীদের থেকে তিনি কী ব্যবহার পেয়েছেন৷ বিশেষ কারণে কলকাতা ছাড়তে হচ্ছে বলে, নিজের ড্রাইভারকে খাওয়াতে পার্ক স্ট্রিট অঞ্চলের এক রেস্তোরাঁয় গিয়েছিলেন তিনি৷ সেখানে তাঁকে দীর্ঘক্ষণ বাইরে অপেক্ষা করানো হয়৷ প্রথমে বলা হয়, টেবিল খালি নেই৷ পরে বলা হয়, চারজনের টেবিল বলে দিতে দেরি করা হচ্ছে৷ কিন্তু ফাঁকা টেবিল দেখতে পেয়ে তিনি যখন খোলসা করে জানতে চান কেন তাঁকে টেবিল দেওয়া হচ্ছে না, তখনই ঝুলি থেকে বেরোয় বেড়াল৷ তাঁকে জানানো হয়, তাঁর সঙ্গে যে লোকটি আছেন তাঁর পোশাক-আশাক ভাল নয়৷ তিনি পাল্টা জানতে চান, রেস্তোরাঁর কোনও ড্রেস কোড আছে কি না৷ কর্মীরা জানান, তা না থাকলেও লোকটিকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি মদ্যপ৷ কেন এরকম মনে হল জানতে চাইলে এক কর্মী জবাব দেন, বাকি কর্মীরাও তাই বলছেন৷ তখন ওই কর্মীকেই তিনি প্রমাণ করে দেখাতে বলেন যে, তাঁর ড্রাইভার মদ্যপ৷ কর্মীটির নামও জানতে চান৷ কিন্তু না কর্মীরা তাকে কোনও সন্তোষজনক উত্তর দিয়েছে, না তাঁদের ঢুকতে দেওয়া হয়েছে রেস্তোরাঁয়৷
সোশ্যাল মিডিয়ায় এ ঘটনা বিস্তারিত বর্ণনা করে যেন শহরের চোখে আঙুল দিয়েই কলকাতার স্বরূপ দেখিয়ে দিয়েছেন ওই মহিলা৷ সামাজিক দ্বিচারিতার জঘন্য নমুনা হিসেবেই এ ঘটনাকে দেখছেন বহু শহরবাসী৷ প্রশ্ন উঠছে, যে শহর দিনে দিনে স্মার্ট হয়ে উঠছে, ঝাঁ-চকচকে কর্পোরেট হয়ে উঠছে, তা কি শুধু বহিরঙ্গে! অন্তরে কি মলিনতা ও দৈন্যতাই বাসা বেধেছে? নয়তো যে শহরে শ্রেণিহীন সাম্যের স্বপ্ন নিয়ে আজও বহু মানুষ বেঁচে আছেন, সেখানেই পোশাকের নিরিখে একটি মানুষকে খাটো করে দেখা হয় কী করে! স্রেফ ধোপধুরস্তপনা কীভাবে মানুষের মাপকাঠি হয়ে উঠল, এই ঘটনার কথা শুনে তাই-ই ঠাহর করে উঠতে পারছেন না বহু শহরবাসী৷ সন্দেহ নেই, বিগত দু’দশকে খোলনলচে বদলে গিয়েছে শহরে৷ বিশ্বায়নের দুনিয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বদলে গিয়েছে শহরবাসীর মানসিকতাও৷ কিন্তু তবু এ শহরের অধিবাসীর কোথাও যেন স্থির বিশ্বাস ছিল যে, দিল্লিতে রাস্তায় যেভাবে দুর্ঘটনাগ্রস্ত মানুষ পড়ে থাকেন, সে নিয়তি অন্তত এখানে কারও হবে না৷ শহরবাসীর প্রত্যয়, আজও মানুষ হিসেবে মানুষের পাশে দাঁড়াতে কলকাতার জুড়ি মেলা ভার৷ কিন্তু এই ঘটনাতে যেন সেই বিশ্বাসের কাচের দেওয়ালেই ঢিল পড়েছে৷ শহরের ঝাঁ-চকচকে হয়ে ওঠা, সময়ের নিয়মে বদলে যাওয়াকে স্বাগতই জানিয়েছিল কলকাতাবাসী৷ কিন্তু তা যে ভিতরে ভিতরে শহরকে এতখানি ফাঁপা করে তুলেছে, তাই-ই বোধহয় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল এই ঘটনা৷ কেউ কেউ মনে করছেন, গ্রাম বা মফস্বলের মানুষের প্রতি একরকমের অশ্রদ্ধার মনোভাব লুকিয়ে তথাকথিত আর্বানদের যে ভাবের ঘরে চুরি, তাই-ই কখনও ধরা পড়ে যায়৷ কর্পোরেট কেতাদুরস্ত রেস্তোরাঁ তাই কি শুধু ফিরিয়ে দিল এক ড্রাইভারকে! নাকি নয়া সভ্যতার দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে গেল শহরের সুনামও! বহু শেয়ারে মহিলার পোস্ট যখন নেটদুনিয়ায় আগুনের মতো ছড়াচ্ছে, তখন গোপনে অপমানিত হওয়া ছাড়া আর কীই-বা করার আছে তিন শতকের শহরের!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.