স্টাফ রিপোর্টার: দু’শো বছর অন্ধকারে কেটেছে। হয়তো আরও তিনশো বছর এভাবেই কেটে যেত। গাছপাতার আড়ালে, ভগ্নস্তূপের মতো। কিন্তু ডা. আলেকজান্ডার গ্রে সাহেবের সমাধিভাগ্য ভাল। বিস্মৃতি, অপরিচিতির আঁধার থেকে ওই মানবদরদী ব্রিটিশ চিকিৎসককে প্রচারের আলোয় তুলে নিয়ে এলেন অনাবাসী এক বাঙালি ডাক্তার। যিনি আদতে কলকাতার বাসিন্দা। কলকাতার বন্ধুবান্ধবদের সাহায্য নিয়ে খুঁজে বের করলেন সাহেবের সমাধি। লেখা হল ইন্দো-ইঙ্গ ভালবাসার নয়া ইতিহাস।
বস্তুত এই শহরকে ভালবেসেই আমৃত্যু এখানে থেকে গিয়েছিলেন ডা. গ্রে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সার্জন চাইলে বাকি জীবন নিজের মাতৃভূমি স্কটল্যান্ডের এলগিন শহরে আরামে কাটিয়ে দিতে পারতেন। তা না করে কলকাতাকেই বানিয়ে ফেলেছিলেন যৌবনের উপবন, বার্ধক্যের বারাণসী। ১৮০৭ সালে কলকাতায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন ডা. গ্রে। এই কলকাতায়। শহরের এক গোরস্থানে সাহেবকে কবর দেওয়া হয়। এইটুকুই জানিয়েছিলেন ডা. হালদারের বন্ধু সতীর্থ ডা. সুতীর্থ রায়। কিন্তু গ্রে সাহেবের অন্তিম ঠিকানা, কবরের অবস্থান কেউ জানত না। তাঁর পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধবও নয়।
অথচ এলগিন জুড়ে সাহেবের বিরাট খ্যাতি। একদা তাঁর দান করা অর্থেই সেখানে গড়ে উঠেছে বিরাট হাসপাতাল, দেশ-বিদেশের স্বনামধন্য চিকিৎসকরা চাকরি করেন। তাঁদেরই একজন ডা. সন্দীপ হালদার। মাস পাঁচেক হল, তিনি কর্মসূত্রে ডা. গ্রে-র হাসপাতালে। ওখানেই প্রথম জানতে পারেন, তাঁর প্রিয় কলকাতায় মাটির নিচে শুয়ে আছেন সাহেব। তারপরই সাহেবের সমাধির খোঁজ শুরু। ফোন করেন পারিবারিক বন্ধু সোমা দাস বোসকে। সোমার ছেলে ১৫ বছরের তরুণ, ক্যালকাটা বয়েজ স্কুলের ছাত্র ইতিহাসপ্রিয় অভিরাজ বিষয়টি শুনে উত্তেজিত হয়ে পড়ে। তারপর খোঁজ শুরু। কলকাতার বেশ কয়েকটি প্রাচীন কবরস্থানে মাকে সঙ্গে নিয়ে অভিরাজ হানা দেয়। আর এক বন্ধু সায়ন্তনী নাগ বিশেষ সাহায্য করেন। অবশেষে তারা সাউথ পার্ক স্ট্রিটের গোরস্থান থেকে খুঁজে বের করেছেন সাহেবকে, থুড়ি সাহেবের গোরস্থানকে। সংগৃহীত হয়েছে প্রচুর তথ্য।
ডা. সন্দীপ হালদার জানিয়েছেন, প্রতিষ্ঠাতার সমাধিস্থলের ঠিকানা জানতে পেরে এলগিনের হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বেজায় খুশি।
ডা. হালদার গত নভেম্বরে ডা. গ্রের হাসপাতালে যোগ দেন। তিনিও সার্জন। কাজে যোগ দিয়ে জানতে পারেন, হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা ডা. গ্রে ১৭৮৩ সালে কোম্পানির সহকারী সার্জনের চাকরি নিয়ে এশিয়ায় পাড়ি দিয়েছিলেন। পরে সার্জন হিসাবে অবসর নেন। শেষজীবন কাটিয়েছেন কলকাতায়, মৃত্যুও সেখানে, মাত্র ৫৩ বছর বয়সে। কিন্তু তাঁর সমাধির হদিশ কেউ জানে না।
এরপর দিনরাত এক করে ডা. গ্রে-কে নিয়ে সন্দীপ পড়াশোনা শুরু করেন। জানতে পারেন অনেক তথ্য। ডা. গ্রে বিয়ে করলেও নিঃসন্তান ছিলেন। স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছিল। মৃত্যুর আগে এলগিন শহরে হাসপাতাল নির্মাণের জন্য ডা. গ্রে ২০ হাজার পাউন্ড দান করেন। তাঁর নামাঙ্কিত হাসপাতাল এখন স্কটিশদের রোগমুক্তির অন্যতম ঠিকানা। সেই সাহেবের সমাধি খুঁজে পেলে আলোড়ন তো পড়বেই। পড়েওছে। ‘দ্য ফ্রেন্ডস অফ ডক্টর গ্রে’ গ্রুপ কৃতজ্ঞতায় ভরিয়ে দিয়েছে সন্দীপকে। আর বিশেষ করে তাঁরা ধন্যবাদ জানিয়েছেন তরুণ তুর্কি অভিরাজ বোসকে। একাধিক স্কটিশ কাগজে খবর হয়েছে।
কেমন ছিল সেই সমাধি আবিষ্কারের মুহূর্ত? অভিরাজ জানাল, “গোরস্থান নিয়ে আমার আগ্রহ ছিল। তাই মায়ের সঙ্গে ডা. গ্রের সমাধি খুঁজতে প্রথমে ভবানীপুর সিমেট্রিতে গিয়েছিলাম। ভবানীপুর থেকেই সাউথ পার্ক রোডের গোরস্থানে যাওয়ার পরামর্শ পাই। প্রায় দু’হাজার কবরস্থানের মধ্য থেকে অবশেষে উদ্ধার করি ডা. গ্রের কবর।” ঘটনাস্থল থেকেই সন্দীপকে ভিডিও কল করা হয়। দেখানো হয় ডা. গ্রের সমাধি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.