স্টাফ রিপোর্টার: বিশ্বায়ন ও নগরসভ্যতা যে ভয়ানকভাবে মানুষের জীবনযাপনের মূল শক্তিপ্রবাহকে ধ্বংস করে দিচ্ছে তার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে কৃষিকে আঁকড়ে ধরে পুজো ভাবনা। মণ্ডপজুড়ে শিল্পী ফিরিয়ে এনেছেন হারিয়ে যাওয়া মাটির ঘ্রাণ, ঢেঁকির তাল, জলের গান এবং কৃষিনির্ভর জীবনের ধারাপাত। বিশেষ করে মাতৃপ্রতিমার গয়না, শাড়ি থেকে শুরু করে সর্বাঙ্গ জুড়েই আউশ ধানের সোনালি গোছায় অলংকার সামগ্রী গড়ে চমকে দিয়েছেন অভিনব এই ভাবনার স্রষ্টা। মহানগর ক্রমশ প্রসারিত হয়ে চাষযোগ্য উর্বর জমিকে দ্রুত বাসযোগ্য করে আবাসনের সুরম্য অট্টালিকা নির্মাণের সিদ্ধান্তকেও কটাক্ষ করেছেন পুজোর ভাবনার রূপকার।
কৃষকের সেই অমোঘ বার্তা ‘কর্ষণ’ ভাবনার মধ্যে থিমশিল্পী রাজু সরকার বলতে চেয়েছেন, ‘আর করব না চাষ/ দেখি তোরা কী খাস?’ আসলে চাষির ছেলে শিক্ষা নিতে শহরে এসে আর গ্রামে ফিরছে না। শীতাতপ ফ্ল্যাটে ঢুকে ভুলে যাচ্ছে গ্রামের মা ও পরিবারকে। উলটোদিকে, নবপত্রিকার পুজো করেও শহরবাসী দ্রুত ঢুকে পড়ছেন এসি-রুমে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই ভুলে যেতে বসেছেন শস্য বিনা প্রাণ ধারণ কার্যত অসম্ভব। কৃষকের ঘাম ও রক্ত দিয়ে তৈরি এক একটি শস্যদানা জেটগতির যুগে পৌঁছে যাওয়া মানুষের সভ্যতার অস্তিত্বকে বহন করে চলেছে। বস্তুত সেই কারণেই অন্ন ও তার স্রষ্টার কথা উৎসবের দিনগুলিতে বিস্মৃতপ্রায় শহরবাসীকে মনে করিয়ে দিতেই এবার সমাজসেবীর ভাবনা ‘কর্ষণ’।
দক্ষিণ কলকাতার লেক রোডে এবছর মণ্ডপে ঢোকার আগেই প্রতিমা দর্শনার্থীরা শুনতে পাবেন শিল্পী লোপামুদ্রার গলায় সভ্যতার উষালগ্ন থেকে শুরু করে আজকের দিনের কৃষি ও কৃষকের জয়গান। মণ্ডপের প্রবেশপথেই দেখা মিলবে বিশাল মাপের লাঙল, মনে হবে এই লাঙলই উপড়ে ফেলতে চাইছে নগরসভ্যতাকে। আসলে লাঙলই হল কৃষকের প্রথম অস্ত্র যা যুগ যুগ ধরে মাটি ‘কর্ষণ’ করে ফসল ফলিয়ে মানুষের অন্নের জোগান দিচ্ছে। মণ্ডপজুড়ে থাকছে ঢেঁকি ছাঁটা চাল, জোয়াল, ঝুড়ি, লাঙল থেকে শুরু করে ধান উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কৃষি ও কৃষকের যাবতীয় সামগ্রী। থাকছে বিশাল বাস্তবের ঢেঁকি। আর কৃষকের পরিবারের চিরন্তন সাথী সেই ঢেঁকির কাছে পৌঁছে দেখবেন, দুই মহিলা ঢেঁকিতে ধান থেকে চাল তৈরি করছেন। সঙ্গে পাশ থেকে ভেসে আসছে গ্রামীণ সভ্যতার অন্যতম অঙ্গ ঢেঁকির গান। যে গান গাইতে গাইতে কৃষকের পরিবারের মা-বোনেরা ঢেঁকিতে পা দিয়ে অন্ন সৃষ্টির আনন্দে মেতে ওঠেন। তাৎপর্ষপূর্ণ হল, বাংলার এই পুরাতনী গান সমাজসেবীর মণ্ডপে এবছর নতুন আঙ্গিকে মনোমুগ্ধকর আবহে ফিরিয়ে এনেছেন প্রখ্যাত সংগীত শিল্পী লোপমুদ্রা মিত্র।
পুজোর কলকাতায়(Kolkata Durga Puja 2024) সাড়া জাগানো এই মণ্ডপের ভিতরে প্রবেশ করে উপরে তাকালে চোখে পড়বে বর্ধমানের সবুজ-সমুদ্র থেকে উঠে আসা একখণ্ড ধানখেত। যেখানে গোছা গোছা ধানগাছ ফুটে উঠেছে। উপরে নিচে বিভিন্ন আঙ্গিকে অভিনব আলোকসজ্জায় থাকছে অজস্র মাটির ভাঁড়, কলসি ও ছোট-বড় ঝুড়ি। থাকবে কৃষকের শ্রমদান, বীজ বপন, ফসল তোলা থেকে শুরু করে জীবনের বৃহত্তর ধর্মপালনের প্রতিটি মুহূর্ত। পাশের দেওয়াল ভিডিও প্রোজেকশনের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হবে কৃষকের জীবনচিত্র। নানা বছরে বহু শারদ সম্মান পাওয়া এই পুজো কমিটির সম্পাদক অরিজিৎ মৈত্রের কথায়, ‘‘পুরো মণ্ডপটাই কৃষি ও কৃষকের জীবনের সঙ্গে যুক্ত পরিবেশবান্ধব সামগ্রী দিয়ে তৈরি। বাংলার শস্যভাণ্ডার বর্ধমান থেকে যেমন অধিকাংশ শস্য ও উপাদান এসেছে, তেমনই মণ্ডপ তৈরির সহশিল্পীরা এসেছেন বীরভূম থেকে। চেষ্টা করা হয়েছে গ্রামবাংলার শস্য জোগানের সেই সনাতনী কাহিনি তুলে ধরতে।’’
দেখুন ভিডিও:
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.