অভিরূপ দাস: এক জীবনে মৃত্যু কতবার আসতে পারে? ডায়মন্ড হারবারের অপর্ণা হালদার (নাম পরিবর্তিত) ৬৫ বছরেই দু দু’বার মৃত্যু ছুঁয়ে এলেন, ক্যানসারের বেশে। ২০১৭-এ স্তন ক্যানসারে (Cancer) আক্রান্ত হয়েছিলেন। সে যাত্রায় অস্ত্রোপচার করে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছিল স্তন। চিকিৎসা পরিভাষায় যে অপারেশনের নাম – মডিফায়েড র্যাডিকাল ম্যাসেকটমি। তারপর সুস্থই ছিলেন। বছর আড়াই কাটতে না কাটতেই আচমকাই সেই কাটা স্তনের জায়গায় ফের ফুসকুড়ি। আবার টিউমার! আবারও মারণরোগ। পরীক্ষা করে ধরা পড়ে, ফের কর্কটরোগ বাসা বেঁধেছে। তবে এবারও মৃত্যুর কাছে হার মানেননি তিনি। সৌজন্যে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের (Calcutta Medical College) একদল চিকিৎসক।
বেসরকারি ক্ষেত্রে এই চিকিৎসার খরচ বিপুল। তাই মেডিক্যাল কলেজের দ্বারস্থ হন অপর্ণা। গত সপ্তাহে কেমোথেরাপি বিভাগে এলে চিকিৎসকরা সন্দেহ প্রকাশ করেন। অন্য কোথাও ছড়ায়নি তো ক্যানসার? পেট সিটি স্ক্যান করা হয় অপর্ণার। সেখানে প্রাথমিকভাবে দেখা যায়, ওইটুকু অংশেই আটকে আছে মৃত্যুর পরোয়ানা। অস্ত্রোপচারের দায়িত্ব গিয়ে পড়ে কলকাতা মেডিক্যালের নতুন ‘ব্রেস্ট এন্ড এন্ডোক্রাইন সার্জারি’ বিভাগের কাছে। বিভাগীয় প্রধান ডা. ধৃতিমান মৈত্রর কথায়, ”প্রথমেই আমরা বায়োপসি করে নিশ্চিত হই। সোমবার শুরু হয় অস্ত্রোপচারের প্রক্রিয়া।” করোনা আবহে এ ধরণের জটিল অস্ত্রোপচার হাতে গোনা রাজ্যে। তার মধ্যে মেডিক্যাল কলেজ যেখানে পুরোমাত্রায় কোভিড হাসপাতাল, সেখানে এ এক ব্যতিক্রমই বটে।
তবে এত কিছু মাথায় রাখেননি চিকিৎসকরা। ডা. মৈত্রর কথায়, “উনি বাঁচতে চেয়েছেন। আমরা চ্যালেঞ্জটা নিয়েছি।” কাটা স্তনের জায়গায় ফের ক্যানসার কোষ। তা কেটে বাদ দেওয়া বড় সোজা কথা নয়। অস্ত্রোপচার চলাকালীন দেখা যায় পাঁজরের কিছুটা অংশে ছড়িয়েছে ক্যানসার। সে অংশটুকুও বাদ দিতে হবে। তিন ঘন্টার কাঁটাছেড়ার পর অপর্ণার শরীরের অবস্থা যা দাঁড়িয়েছিল, তা যে কোনও সাধারণ মানুষ দেখলে আঁতকে উঠতেন। কেটে বাদ দিতে দিতে বুকে বিশাল একটা গর্ত তৈরি হয়। একহাত দূর থেকেই দেখা যাচ্ছিল হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানি, ফুসফুসের ওঠানামা। “ফুসফুসের একটা আচ্ছাদন থাকে। তার নাম প্লুরা। আর হৃৎপিণ্ডের আচ্ছাদন পেরিকার্ডিয়াম। অনেকটা টিস্যু বাদ দেওয়ায় অস্ত্রোপচারের পর সেই আচ্ছাদন দুটি দৃশ্যমান হয়ে গিয়েছিল।” জানিয়েছেন ডা. মৈত্র।
কেটে বাদ দেওয়া সহজ, কিন্তু তা মেরামত করাই আসল। এ অস্ত্রোপচারে রোগীকে ফের পুনরায় আগের অবস্থায় নিয়ে আসাই ছিল চ্যালেঞ্জ। পাঁজরের যে অংশ বাদ গিয়েছে, প্রথমে সেখানে পলি প্রপিলিন মেশ লাগানো হয়। তারপরে স্রেফ চামড়া বসিয়ে দিলেই কাজ শেষ হতো না। তাহলে অদূর ভবিষ্যতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারতো হৃৎপিণ্ড। “গর্তটা অনেকটাই গভীর। প্রচুর টিস্যু মাসল বাদ দিতে হয়েছিল। আর যেহেতু স্তন আগেই বাদ পড়েছিল, তাই এক্ষেত্রে ব্রেস্ট নয় আমাদের চেস্ট রিকনস্ট্রাকশন করতে হতো,” জানিয়েছেন ডা. মৈত্র। ঠিক হয়, তলপেট থেকে মাংস এনে বুকের ওই জায়গায় বসানো হবে। তলপেটের এই অংশের নাম ভার্টিকাল রেক্টাস এবডোমিনিস ফ্ল্যাপ। যা শূন্য বুকের ফাঁকা জায়গায় বসানো হয়।
যেহেতু তলপেটের মাসল নেওয়া ,তাই ভবিষ্যতে হার্নিয়া হওয়ার একটা আশঙ্কা ছিল। তলপেটেই তাই একটি মেশ বসিয়ে দেওয়া। জুড়ে দেওয়া অংশে রক্তসঞ্চালন স্বাভাবিক। একটাই জীবন আর একবারই মৃত্যু – এমন প্রচলিত বিশ্বাসকে দুয়ো দিয়েছেন অপর্ণা। দ্বিতীয় জীবন পেয়ে ধন্যবাদ জানিয়েছেন কলকাতা মেডিক্যালের ব্রেস্ট এন্ডোক্রাইন বিভাগকে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.