অর্ণব আইচ: দুপুর সোয়া একটা বাজলেই বেহালার (Behala) শ্যামবাবুর পুকুরের পাড়ে দাঁড়ান তিনি। মাথায় থাকে হলুদ রঙের হেলমেট। হাতে একটা বড় বাটি। তাতে ভরতি মুরগির নাড়িভুঁড়ি ও মাংসের ছাট। এগুলির অপেক্ষাতেই গাছের উপরে ওঁৎ পেতে থাকে উড়ন্ত শিকারিরা। কখন আসবে লোকটা? সময় হলেই আসেন তিনি। পুকুর পাড়ে এসে তিনি শুধু ডাকেন, “আয়, আয়”। এর পর আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ঝাঁকে ঝাঁকে আসতে শুরু করে সোনালি ডানার চিলের (Hawk) দল। চরকি পাকে ঘুরতে শুরু করে পুকুরের উপরে। স্টিলের বাটি থেকে মাংসের টুকরো নিয়ে তিনি ছুড়ে দেন শূন্যে। একের পর এক চিল এসে উড়ন্ত অবস্থায় ছো মেরে লুফে নেয় সেই মাংসের টুকরো। যেগুলো লুফতে পারে না, সেগুলো পুকুরে পড়ে গিয়ে মাছের খাদ্য হয়। এই দৃশ্য দেখতে আশপাশের বাড়ি ও বহুতলের জানলা বা বারান্দা থেকে উঁকি দেয় বহু চোখ।
ক্ষুধার্ত চিলের মুখে খাবার জোগানো এই মানুষটির নাম সুকুমার মাঝি। এলাকার বাসিন্দারা ডাকেন ‘চিল-বন্ধু’ বলে। দক্ষিণ বেহালা রোডে শ্যামবাবুর পুকুরের পাশে একটি ছোট গুমটি দোকান। সেখানেই মুরগির মাংস বিক্রি করেন সুকুমারবাবু। এটাই তাঁর ব্যবসা। কিন্তু শখটা যে অন্যদের থেকে একেবারেই আলাদা। গত পাঁচ বছর ধরে এভাবেই চিলদের খাইয়ে চলেছেন ওই ব্যক্তি।
কলকাতার বহু মানুষ রাস্তার কুকুর বা বিড়াল খাওয়ান। অনেকে আবার খাওয়ান কাক বা মাছকেও। কিন্তু চিল খাওয়ানোর দৃশ্য কলকাতায় খুবই বিরল। বরং বাজার হাটে চিল উড়লে অনেকেই বিরক্ত হন। তবু তিনি চিলকে খাওয়ান কেন? এই প্রশ্ন তুলতেই জানালেন, অন্যান্য প্রাণীদের খাওয়ানোর মতো বহু লোক আছে। কিন্তু চিলদের কেউ খাওয়ায় না। অথচ বাস্তুতন্ত্রে চিলেরও ভূমিকা রয়েছে। কুকুর, বিড়াল বা কাকও বিভিন্ন ধরনের খাবার খেতে পারে। কিন্তু ছিল যে মাংস ছাড়া কিছু খাবে না।
যেহেতু সুকুমারবাবুর নিজের মাংসের ব্যবসা, তাই দুপুরে বিক্রিবাটা শেষ হওয়ার পর নাড়িভুঁড়ি ও মাংসের ছাট, আবার কখনও বা না বিক্রি হওয়া মাংসের টুকরো ছোট ছোট করে কাটেন। এর পর এসে দাঁড়ান পুকুরের পাশে। চিলগুলিও চিনে গিয়েছে তাঁকে। একবার ডাকলেই দলে দলে উড়ে আসে। ছোট থেকেই ডানা মেলে চিলের ওড়া দেখতে ভালোবাসেন সুকুমারবাবু। আর এখন উড়ন্ত অবস্থায় মাংস লোফা না দেখলে তাঁর চলে না। এটাই তাঁর প্রত্যেকদিনের রুটিন। গত কয়েক মাস আগে এভাবে খাওয়ানোর সময় হয়তো খাবার না পেয়েই একটি চিল হঠাৎ তাঁর চোখে আঘাত করেছিল। এর পরও তিনি দমে যাননি। শুধু হেলমেট কিনে মাথায় পরে নিয়েছেন। এখন তাঁর আর কোনও অসুবিধা হয় না বলেই দাবি।
বিশেষজ্ঞরাও জানাচ্ছেন, চিলের মূল খাদ্য হচ্ছে মাংস জাতীয় বস্তু। সেই কারণেই মাছের বাজারে চিলদের উড়তে দেখা যায়। পড়ে থাকা মাছের টুকরো অথবা মৃত পশুর দেহাংশ তারা খায়। এ ছাড়াও ছোট প্রাণী ও পোকা শিকার করে চিল। দক্ষিণ বেহালা রোডের ওই পুকুর সংলগ্ন এলাকায় তৈরি হচ্ছে বহুতল। তার মধ্যেই কখনো-সখনো রয়েছে একটু সবুজের ছোঁয়া। রয়েছে তালগাছ আর নারকেল গাছও। এলাকার বাসিন্দারা জানালেন, সুকুমারবাবু খাওয়ানো শুরু করার পর থেকে এই গাছগুলিতে বাসা বাধতে শুরু করেছে চিল। এখনও রয়েছে প্রচুর চিলের বাসা। তারা ছাড়াও বাইরে থেকেও বহু চিল উড়ে আসে এই মধ্যাহ্নভোজের লোভে। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাস চিলের প্রজননের সময়। বাসিন্দাদের আশা, আরও অনেক চিল এই সময় বাসা বাঁধবে তাঁদের এলাকায়। সুকুমার মাঝিকে দেখে চিল খাওয়ানোর জন্য আরও অনেকে এগিয়ে আসুন, তা-ই চান দক্ষিণ বেহালা রোডের বাসিন্দারা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.