সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: #MeToo-র ঝড়ে যখন উত্তাল গোটা দেশ, সেই তখনই মানবিকতার অনন্য দৃষ্টান্ত গড়লেন অ্যাপ ক্যাবের চালক। পুজোর শহরে একা মা-মেয়েকে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েও রয়ে গেলেন, শুধু মানবিকতার খাতিরে। পরবর্তী যাত্রীকে নেওয়ার চেষ্টাই করেননি তিনি। গভীর রাতে মা-মেয়েকে নিরাপত্তা দিতেই অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করলেন তিনি। এ শুধু ছক ভাঙা ঘটনাই নয়, এ যেন ভারতীয় সংস্কৃতির অন্যতম অঙ্গ। বহুদিন পর সেই স্বাদ ফিরিয়ে দিলেন ওই অ্যাপ ক্যাব চালক।
ঘটনার সূত্রপাত দিন দুয়েক আগে। মা-কে সঙ্গে নিয়ে অ্যাপ ক্যাব বুক করেন প্রিয়দর্শিনী গুহ। রাত তখন অনেকটাই বেড়েছে। গন্তব্যে পৌঁছানোর পর মা মেয়ে দেখেন তাঁদের আবাসনের প্রধান প্রবেশদ্বারে তালা পড়ে গিয়েছে। ফোন করেও প্রহরীকে পাওয়া যাচ্ছে না। রাস্তার উপরেই আবাসন, তাই ক্যাব থেকে নেমেই ফোন করে প্রহরীকে ডাকাডাকি শুরু করেছেন। তখনও গাড়ি ঘুরিয়ে পরের যাত্রী তুলতে চলে যাননি ক্যাব চালক সন্তোষ। গাড়ি থেকে বেশ কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে দুই মহিলার চিন্তিত পদক্ষেপ তাঁর নজরে। কোনও সমস্যা হয়েছে বুঝতে পেরে নিজেই এগিয়ে আসেন। গোটা ঘটনাটি শোনার পর তিনিও তাঁদের সঙ্গে অপেক্ষা করতে শুরু করেন। অনাত্মীয় দুই মহিলাকে একা ফেলে চলেই যেতে পারতেন সন্তোষ। কিন্তু তিনি থেকে যান। ততক্ষণে ফোনে পরবর্তী যাত্রীর গন্তব্য ও হালহকিকত চলে এসেছে। সেই রাইড তৎক্ষণাৎ বাতিলও করে দেন তিনি। জানিয়ে দেন। এই রাতে আর কোনও যাত্রী নেবেন না। প্রায় দেড় ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর আবাসনের গেট খুললে মা-মেয়ে বাড়িতে ঢোকেন। তা দেখার পর নিশ্চিন্ত হয়ে পরবর্তী গন্তব্যে রওনা দেন ওই ক্যাব চালক।
গোটা দেশেই রাতের শহর মহিলাদের জন্য নিরাপদ নয়। এই সত্য অস্বীকার করার জায়গা যে আজ নেই তা সংবাদমাধ্যমের দিকে নিয়মিত চোখ রাখলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে। কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি এখন আকছার ঘটে। আগে চাকরি বাঁচাতে অনেকেই চুপ থাকতেন। এখন সেখানে #MeToo-র আধিপত্য। সেখানে রাত একটায় দুই মহিলার খোলা আকাশের নিচে কাটানো যে বিপদ ঘাড়ে করে ডেকে আনা, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আর যাঁরা বিপাকে পড়ে বাইরে থাকতে বাধ্য হয়েছেন, তাঁদের মধ্যেও আতঙ্ক দানা বাঁধে। এই বুঝি ওঁত পেতে থাকা অজানা বিপদ ঝাঁপিয়ে পড়ল। অনেক পরিচিত মানুষই দিনের আলো পড়লে বড় বেশি অপরিচিত হয়ে ওঠে। সেই বিশ্বাসের জায়গাটাতেই ঘুণ ধরেছে। পরিবেশ পরিস্থিতি এই ঘুণের প্রবণতাকে বিপজ্জনক হারে বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই অপরিচিতকে বিশ্বাস করার সাহস দেখানো কষ্ট কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। সেখানে সন্তোষের মতো একজন অ্যাপ ক্যাব চালক যে সাক্ষাৎ দেবদূতের সঙ্গে তুলনীয় হবেন এ আর আশ্চর্য কী। মা-কে সঙ্গে নিয়ে প্রিয়দর্শিনী দুরুদুরু বক্ষে বিপদের অপেক্ষা করলেও নিরাপদেই কেটেছে দেড়টি ঘণ্টা। নিশ্চিন্তে ঘরে ফিরেছেন তাঁরা। কিছুই হয়নি, এটি তাঁর কর্তব্য ছিল- এভাবেই মা-মেয়ের সঙ্গে সময় কাটিয়ে দিয়েছেন অ্যাপ ক্যাবের চালক। মনের মধ্যে জমে থাকা আতঙ্ক সরিয়ে সেসময় আর ধন্যবাদ দেওয়া হয়নি। ধূলো উড়িয়ে ক্যাবের চাকা ঘোরাতেই তাই ঠাকুরের উদ্দেশ্যে দুহাত কপালে ছোঁয়ান মা-মেয়ে। সোশ্যাল মিডিয়াতেই সন্তোষবাবুর মঙ্গল কামনা করেছেন তাঁরা। মূল্যবোধ হীনতার নৈরাজ্যে সন্তোষের মতো মানুষ মরুদ্যানের মতো। দেবীপক্ষে এ এক প্রাপ্তি বৈকি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.