রূপায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়: মিছিলের মাথা যখন শ্যামবাজার। আর লেজ রয়েছে মহাত্মা গান্ধী রোডে। সন্ধ্যা পর্যন্ত ৬ নম্বর মুরলীধর সেন লেনের ম্যানেজাররাও ব্যস্ত ছিলেন এদিন মিছিলে কত লোক হয়েছে সেই হিসাব কষতে। কলকাতার বুকে বিজেপির এত বড় বর্ণময় মিছিল শেষ কবে হয়েছিল তা মনে করতে পারছিলেন না রাজ্য বিজেপি নেতারা। অনেকে আবার সোমবার মহামিছিলের সঙ্গে লোকসভা নির্বাচনের সময় কলকাতায় অমিত শাহর রোডশোর তুলনা করেছেন।
শুধু ভারে নয়, রঙেও ছিল বর্ণময় হয়ে উঠেছিল আজকের মিছিল। কোথাও বাজছে ধামসা—মাদল। উঠেছে সিঙার আওয়াজ। কোথাও আবার ঢাকের বোলে পা মিলিয়েছে সমর্থকরা। সুসজ্জিত ট্যাবলো মিছিলকে আরও রঙীন করে তুলেছিল। ভিড়ের চাপে অনেক জায়গাতেই সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ে দু’লেনেরই দখল নিয়েছিল গেরুয়া সমর্থকরা। স্বেচ্ছাসেবকরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন জনসমাগমকে সুশৃঙ্খল রাখার। CAA’র বিরোধিতায় কলকাতা থেকেই মিছিল শুরু করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। টানা তিনটি মিছিল করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তাই পালটা মিছিলের জন্য কলকাতাকেই বেছে নিয়েছিল গেরুয়া শিবির। দেশজুড়ে যখন প্রতিবাদের ঢেউ সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতায়। বিরোধীরা আন্দোলনে পথে নেমেছে। এ রাজ্যেও তৃণমূল ও বামেরা একাধিক মিছিল করেছে সিএএর বিরুদ্ধে। তখন নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের সমর্থনে জেপি নাড্ডার নেতৃত্বে মিছিলকে সফল রূপ দেওয়াটাও চ্যালেঞ্জ ছিল বিজেপির কাছে। তবে মিছিলে জনসমাগম দেখে দিনের শেষে স্বস্তির হাসি রাজ্য বিজেপি নেতৃত্বের।
ক’দিন আগেই রাজ্যে তিনটি কেন্দ্রের উপনির্বাচনে হারার পর দলের জনসমর্থনে ভাটা পড়েছিল বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন দলের কেউ কেউ। উপনির্বাচনের হারের পর কর্মীদের মনোবলও অল্পবিস্তর ধাক্কা খেয়েছিল। এদিন সিএএর সমর্থনে কলকাতার বুকে দলের মহামিছিলে স্বতস্ফূর্ততা ও ভিড় দলীয় কর্মীদের মনোবল কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে বলেই দাবি বিজেপি নেতাদের। তাই মিছিল শেষে দলের সর্বভারতীয় কার্যকরী সভাপতি জে পি নাড্ডাও বলেছেন, অভুতপূর্ব দৃশ্য দেখলাম। বিশাল মিছিল। মানুষ স্বাগত জানাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছেন। এই বিশাল স্বতস্ফূর্ত জনসমাগম বলছে সিএএর পক্ষে বাংলা। বাংলার মানুষ নরেন্দ্র মোদির সঙ্গেই আছেন।
ওয়েলিংটন থেকে নির্দিষ্ট সময়ের পরে দুপুর সওয়া দু’টো নাগাদ মিছিল শুরু হয়। তখন অবশ্য ওয়েলিংটন ছাড়িয়ে কর্মী—সমর্থকদের ভিড় চলে গিয়েছে লেনিন সরণিতে। অন্যদিকে, ভিড়ে অবরুদ্ধ সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউও। দড়ির চারটি ব্যারিকেড করা হয়েছিল। প্রথম ব্যারিকেডের মধ্যে হুডখোলা জিপে ছিলেন জেপি নাড্ডা। সঙ্গে রাজ্যের দলের পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয়। মিছিলে হাঁটেন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ, কেন্দ্রীয় নেতা অরবিন্দ মেনন, রাহুল সিনহা, মুকুল রায়, কেন্দ্রীয় দেবশ্রী চৌধুরি ও বাবুল সুপ্রিয়, সাংসদ স্বপন দাশগুপ্ত, লকেট চট্টোপাধ্যায়, নিশীথ প্রামাণিক, এস এস আলুওয়ালিয়া, অর্জুন সিং, রূপা গঙ্গোপাধ্যায়, সব্যসাচী দত্ত প্রমুখ। তারপরের ব্যারিকেডে ছিলেন রাজ্য নেতৃত্ব, দলীয় সাংসদ ও বিধায়করা। তৃতীয় ব্যারিকেডের মধ্যে সেলিব্রিটিরা। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ ধরে মিছিল যতই এগিয়েছে ভিড় বেড়েছে। মুহুর্মুহু ক্যামেরার ফ্ল্যাশ বাল্বের ঝলকানি। তারই মাঝে ভিড়ের মাঝ থেকে নিরাপত্তা রক্ষীদের ঘেরাটোপ এড়িয়ে একটু কাছ থেকে কর্মী—সমর্থকরা মোবাইলে ছবি তোলার চেষ্টা করেছেন মোদি—শাহর প্রধান সেনাপতি জে পি নাড্ডার।
মিছিলে মতুয়া—কীর্তনীয়া সম্প্রদায়ের মানুষজনের উপস্থিতি ছিল ভালই। সিএএ বিল পাসের মাধ্যমে উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়েছে মিছিলে উপস্থিত জনতা। রাস্তার মাঝে চলেছে ফুল দিয়ে স্বাগত জানানো। আর হুডখোলা জিপে রাস্তার দু’ধারে উপস্থিত মানুষদের উদ্দেশে হাত নাড়িয়েছেন নাড্ডা। জনস্রোতের মধ্যে থেকে স্লোগান উঠেছে ‘মোদি—মোদি’, জয় শ্রীরাম, কখনও আবার জয় মা কালী। সওয়া চারটে নাগাদ মিছিল শেষ হয় শ্যামবাজারে। ভূপেন্দ্র বোস অ্যাভিনিউয়ে বিশাল মঞ্চ করা হয়েছিল। সেখানেই বক্তব্য রাখেন জে পি নাড্ডা, কৈলাস বিজয়বর্গীয়, দিলীপ ঘোষরা। দিলীপ ঘোষ বলেন, মুখ্যমন্ত্রী অনুপ্রবেশকারীদের হয়ে কাজ করছেন। বাংলায় সিএএর বিরোধিতায় অশান্তি রুখতে পুলিশের গুলি চালানো উচিত ছিল বলে এদিন ফের মন্তব্য করেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি।
আর বক্তব্য রাখতে উঠে তৃণমূলকে কার্যত হুঁশিয়ারি দেন বিজেপির কার্যকরী সভাপতি জগৎপ্রকাশ নাড্ডা। তিনি বলেন, ‘লোকসভায় তো ট্রেলর হয়েছে। কিন্তু, ২০২১ সালে পুরো সিনেমা দেখবে তৃণমূল। এর আগেও আমি বাংলায় এসেছি। কিন্তু, কোনওদিন এই দৃশ্য দেখিনি। অল্প রাস্তা আসতে তিনঘণ্টার বেশি সময় লাগল। ছাদ থেকেও মানুষ হাত নাড়ছেন। কেউ কেউ জানলা দিয়ে ফুল ছুঁড়ছেন। এটাই হাওয়া বদলের সংকেত। আশাকরি মমতাদিদিও এটা বুঝতে পারছেন।’
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.