শুভময় মণ্ডল: বাড়ি কলকাতা থেকে অনেকটাই দূরে। পেটের দায়ে কাজে আসতে হয়েছিল কলকাতায়। কারও বাড়িতে ছয় মাসের বাচ্চা কারও স্ত্রী আবার অন্তঃসত্ত্বা। পরিবারের দায়ভার থেকে বাচ্চার মুখের দুধ জোগানও সবটাই ছিল ওদের হাতে। ২২ মার্চ হঠাৎ ঘোষণা হয় একদিনের জন্য জনতা কারফিউ হবে। কিন্তু তারপর কেউ ভাবতেও পারেনি তারপরের দিন থেকেই অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে দোকানপাট। শুরু হয়ে যাবে লকডাউন।
এঁদের মধ্যে কেউ কাজ করেন উত্তর কলকাতার অলিগলি চায়ের দোকানে। কেউ আবার রাস্তার ধারের অফিসপাড়ার হোটেলে বাসন মাজেন। এতদিন ভোর পাঁচটা থেকে উঠে রাত বারোটা অবধি চলত অক্লান্ত পরিশ্রম। ব্যস্ত শহর কলকাতায় চারিদিকে গাড়ির হর্নের আওয়াজে সকাল হতো তাঁদের। এখন তাঁরা পরিযায়ী শ্রমিক। সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রমের পর রাত্রে কিছুক্ষণ কথা হতো পরিবারের সঙ্গে। স্ত্রী, সন্তানের সঙ্গে কথা বলে ক্ষণিকের আনন্দ নিয়েই পরের দিনের সকাল হওয়ার পরীক্ষা করত। আবার পেটের তাগিদে স্বামী-স্ত্রী মিলে বাচ্চাদের বাড়িতে রেখে কাজ করতেন, এমন উদাহরণও নেই তা নয়। লকডাউনে আজ তাঁরা কর্মহীন। পরিবারের থেকে দূরে থাকায় স্বস্তিও নেই। প্রতিনিয়ত পরিবার-পরিজনকে ফোন করে খোঁজ নিয়ে চলেছেন তারা খেতে পাচ্ছে কিনা। কী করে জোগাড় করবেন বাড়িতে ফেলে আসা বাচ্চা দুধ অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীয়ের ওষুধ? লকডাউনের কারণে বন্ধ রুজি। নিজের অন্নসংস্থান হচ্ছে অন্যের ভরসায়। অজানা কেউ তুলে নিয়ে গিয়ে থাকতে দিয়েছে কোন এক অচেনা জায়গায়। এই ভাবেই দিন কাটছে লকডাউনে।
মানিকতলার বাসিন্দা বিকাশ জয়সওয়াল। পরিযায়ী শ্রমিকরা তাঁকে কখনও দেখেননি। কিন্তু লকডাউন তাঁদের কাছাকাছি এনেছে। ১৮০ জন শ্রমিকের দায়ভার লকডাউনে প্রথম দিন থেকে কাঁধে তুলে নিয়েছেন তিনি। দু’বেলা নিজের সামর্থ্য মতো বিকাশবাবু তাঁদের খাওয়াচ্ছিলেন এতদিন। জয়সওয়াল সমাজ নিজেরাই কমিউনিটি কিচেন করে। তবে এবার বিকাশ জয়সওয়ালের কাছে বাড়ি ফেরার ইচ্ছা প্রকাশও করেন প্রায় ১৮০ জন। অনেকবার চেষ্টা করেন তাঁরা বিহারে যাওয়ার। কিন্তু সম্ভব হয়নি৷ বারবার বলা হয় সরকারি নিয়ম মেনে আবেদন করতে। কিন্তু সেটা কিভাবে করেতে হত সেটা তাঁদের জানা ছিল না৷ তাঁরা জানতেন শুধুমাত্র বাড়ির ঠিকানা। পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিহার পাঠানো লকডাউনের মধ্যে খুব সোজা বিষয় নয়। তারমধ্যেই সবাই কর্মহীন। ফলে পকেটও ফাঁকা।
সাতপাঁচ ভেবেই বিকাশবাবু শুরু করেন সরকারি নিয়ম মেনে বাড়ি যাবার ব্যবস্থা করতে৷ যাঁরা চেয়েছিলেন বাড়ি যেতে, তাঁদের নামও লিখে নেওয়া হয়। নিয়ম অনুযায়ী ৩০ জনের বেশি একটি বাসে যেতে পারবেন না। সেই সব আবেদন করে সোমবার হাতে আসে ছাড়পত্র। ধর্মতলায় ৩০ জনকে থার্মাল স্ক্যান করে বাসে তুলে দেন বিকাশ জয়সওয়াল। শ্রমিকদের মুখে বাড়ি ফেরার একরাশ হাসি থাকলেও উদ্যোক্তার মন খারাপ ছিল৷ বিকাশবাবু জানিয়েছেন যে, ‘অনেকদিন এঁদের সঙ্গে সময় কাটানো গেল, খুব ভাল লাগছে। এবার বাড়ি ফিররেই চিন্তা দূর হবে।’ প্রথম পর্বের ৩০ জন যাবার পরেই বাকি পরিযায়ীদের বাড়ি যাওয়ার ব্যবস্থাও শুরু করা হয়েছে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.