তরুণকান্তি দাস: এ এক নতুন ট্রেন্ড৷ ক্রেতা ও বিক্রেতা দুই তরফের গায়েই ব্যাঙ্কের ঋণ-অনাদায়ীর তকমা৷ রিয়েল এস্টেটের বাজার ধুঁকছে৷ তার প্রভাব পড়েছে ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রেও৷ এখন ব্যাঙ্কগুলির ঋণখেলাপির খাতায় মহানগর ও তার বৃহত্তর ক্ষেত্রের বাড়ি, ফ্ল্যাটের ক্রেতা ও নির্মাতা সংস্থাগুলির তালিকা দীর্ঘ৷ সবচেয়ে বড় কথা হল, ঋণ দেওয়ার পর অনাদায়ী হলেও সেই টাকা তুলতে পারছে না ব্যাঙ্ক৷ কেননা, যে সম্পত্তির জন্য ঋণ দেওয়া হয়েছে তার বাজার দর পড়ছে হু হু করে৷ কিস্তির টাকা দিতে অপারগের সংখ্যা বাড়ছে৷ সর্বশেষ সমীক্ষা বলছে, ৩০ শতাংশ টাকা ফিরছে না ব্যাঙ্কে৷
কলকাতার বাজারে এখন রিয়েল এস্টেটের জন্য ঋণ দিয়ে বিপাকে পড়েছে বিভিন্ন ব্যাঙ্ক৷ এর দু’টি দিক রয়েছে৷ প্রথমত, যাঁরা কিনছেন তাঁদের অনেকেই আসলে লগ্নিকারী৷ শেষ পর্যন্ত সেই বাড়ি বা ফ্ল্যাট বিক্রি করে লাভের মুখ দেখতে চান তাঁরা৷ এই ধরনের লগ্নিকারীর সংখ্যা কম নয়৷ বহুতলের ভিতের ইট গাঁথার সময়েই তাঁরা এলাকার চাহিদা বুঝে এক বা একাধিক ফ্ল্যাট বুকিং করেন৷ প্রোমোটারও কাঁচা টাকা হাতে এলে মূলধন কম লাগবে বলেই সেই সুযোগ কাজে লাগান৷ পরে কিছুটা নির্মাণ এগোনোর পর সেই ফ্ল্যাট হাতবদল করে মোটা টাকা লাভ করেন বিনিয়োগকারী, যাঁরা আসলে মধ্যস্বত্বভোগী৷ লাভের অঙ্ক যেহেতু যথেষ্ট আকর্ষণীয় সেই কারণে অনেকে কালো টাকা বিনিয়োগ করলেও কেউ কেউ আবার ব্যাঙ্কের ঋণ নেন৷ তারপর দাঁও মেরে লাভের অঙ্ক ঘরে তুলে বাকিটা পরিশোধ করেন৷ তা ছাড়া সাধারণ ক্রেতা নিজের জন্য ফ্ল্যাট কেনেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঋণ নিয়েই৷ এখন পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, ঋণের টাকা শোধ করতে কালঘাম ছুটছে সবার৷ ফলে খেলাপির সংখ্যা বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে৷ এই মুহূর্তে কলকাতার বাজারে ব্যাঙ্কগুলির ঋণগ্রাহকদের প্রায় ৩০ শতাংশ খেলাপি বলে খবর৷ টাকার অঙ্কটাও বিশাল৷ ক্রেডাই-এর কর্তা হর্ষবর্ধন পতোদিয়া স্বীকার করেছেন অর্থনৈতিক সঙ্কটে নির্মাণ শিল্প৷ বাজারও পড়েছে৷ তাঁর কথায়, “মানি ফ্লো কম৷ তাই সমস্যা রয়েছে৷ তবে ফ্ল্যাট বিক্রি হচ্ছে না তা নয়৷ চাহিদা কমেছে তাও নয়৷ নির্দিষ্ট রেঞ্জের ফ্ল্যাট কেনার লোক আছে এখনও৷ তবে কলকাতার লাগোয় জেলাগুলিতে যত ভাল, আধুনিক আবাসন হচ্ছে ঠিক ততটা সাড়া মিলছে না৷ ঋণ খেলাপি বাড়ার অন্যান্য কারণও রয়েছে৷” ব্যাঙ্কগুলির সমীক্ষা ও রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্য বলছে, আগে ইস্পাত শিল্পে অনাদায়ী বেশি ছিল৷ এখন সেই জায়গা নিচ্ছে আবাসন৷ এবং এক সঙ্গে বড় অঙ্ক না হলেও, সর্বমোট অঙ্কটা বেশ ভারী৷
তবে আবাসন শিল্পে যুক্তরা বলছেন, চাহিদা থাকলেও কোনও প্রকল্প যে সময়ের মধ্যে শেষ করে ক্রেতাদের হাতে তুলে দেওয়ার কথা তা সবসময় করা যাচ্ছে না৷ অধিকাংশ প্রকল্প সময় পার করেও শেষ হয়নি, শেষ হলেও সব ফ্ল্যাট বা বাংলো বিক্রি হচ্ছে না৷ তার অন্যতম কারণ হল, প্রকল্পের সব ফ্ল্যাট বিক্রি হয়ে যাচেছ এমনটা নয়৷ কিছু বুকিং হচ্ছে৷ বাকি পড়ে থাকছে৷ সেই অবস্থায় প্রকল্প শেষ করতে গেলে আরও টাকা লাগছে৷ প্রয়োজন হচ্ছে ব্যাঙ্ক ঋণের৷ কিন্তু তারপরও ফ্ল্যাট বিক্রি না হলে ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না৷ এটাই বর্তমান বাজারের হাল৷ উত্তরে বি টি রোড, বারাসাতের সংযোজিত অঞ্চল, বৃহত্তর রাজারহাট, হাওড়ার কোনা, আমতলা ও বারুইপুরের বেশ কিছু প্রকল্পে এই ছবিটা প্রকট৷ ব্যাঙ্ক ইউনিয়নের এক কর্তা বলেন, “ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় বেশ কিছু ফ্ল্যাট ‘ক্রোক’ করার পর বিক্রির বন্দোবস্ত করা হয়৷ তখন দেখা যাচ্ছে তার বাজার দর পড়ে যাওয়ায় সুদ-সহ আসল দূরে থাক, মূল টাকা পাওয়াটাই দুষ্কর হয়ে দাঁড়াচ্ছে৷ এই ঘটনা বাড়ছে৷ অদূর ভবিষ্যতে পড়তি আবাসন শিল্প বড় ধাক্কা দেবে ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রকে৷”
তা ছাড়া আগে এক শ্রেণির বিনিয়োগকারী ফ্ল্যাট বুকিং করে রাখতেন৷ বাজার চড়লে সেই ফ্ল্যাট বেচে লাভের টাকা ঘরে তুলতেন৷ তাও এখন আর সহজ হচ্ছে না৷ বেশ কিছু আধুনিক কমপ্লেক্সে প্রতি মাসে যে পরিমাণ রক্ষণাবেক্ষণ ও আনুষঙ্গিক খরচ দিতে হয় কোনও বাসিন্দাকে, তাও সবার সাধ্যের মধ্যে নয়৷ বিশেষ করে সুইমিং পুল, জাকুজি, কমিউনিটি হল, ক্লাব, পার্ক-সহ নানা সুযোগ সুবিধা রয়েছে এমন প্রকল্পে নিজেদের ঠাঁই পেতে ঋণ গ্রহণের সংখ্যা বেশি৷ সেখানে অনাদায়ীর হারও বেশি৷ যা ভাবাচ্ছে ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রকে৷
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.