স্টাফ রিপোর্টার: সরকারি অনুষ্ঠানে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দেওয়া নিয়ে এবার বিজেপির অন্দরেই প্রবল দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে গেল। শুক্রবার হাওড়া স্টেশনে ‘বন্দে ভারত’ এক্সপ্রেসের (Vande Bharat Express) উদ্বোধনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে বিজেপি কর্মীদের ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান নিয়ে বঙ্গ বিজেপিতে মতভেদ প্রকাশ্যে চলে এল। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী সরকারি অনুষ্ঠানে এই স্লোগানের পাশে দাঁড়ালেও তাঁর দলের অনেকেই এই আচরণকে সমর্থন করেননি।
কেউ প্রকাশ্যে শুভেন্দুর সমর্থন করাকে নস্যাৎ করে ভিন্ন মত পোষণ করেছেন। কেউ আবার দলের অন্দরে বলেছেন, সরকারি অনুষ্ঠানে এই স্লোগান দেওয়া ঠিক হয়নি। বিজেপি সাংসদ (BJP MP) এস এস আলুওয়ালিয়া, বিজেপি পরিষদীয় দলের মুখ্যসচেতক মনোজ টিগ্গাদের মুখে অবশ্য শোনা গিয়েছে অন্য সুর। আবার রেলমন্ত্রী অশ্বিণী বৈষ্ণব থেকে কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী সুভাষ সরকারও স্লোগানকারীদের থামার জন্য করজোড়ে অনুরোধ করেছেন। তখন গেরুয়া কর্মীদের একাংশের ‘জয় শ্রীরাম’ (Jai SriRam)স্লোগান দেওয়াকে সমর্থন করে সরকারি অনুষ্ঠানস্থলে দাঁড়িয়েই মুখ্যমন্ত্রীকে নজিরবিহীনভাবে আক্রমণ করে শুভেন্দু অধিকারীর মন্তব্য, ‘‘এরকম ঘটনা আরও হবে। যতদিন রাজনীতিতে থাকবেন ভুগতে হবে।’’ শুভেন্দুর দাবি, তাঁর সঙ্গে নাকি এক মঞ্চে বসতে চাননি মুখ্যমন্ত্রী। তাই এটা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। মুখ্যমন্ত্রীকে অসম্মান করে আরও নানা কুরুচিকর ভাষায় আক্রমণ করেন বিরোধী দলনেতা।
অবশ্য বিরোধী দলনেতাকে জবাব দিতে দেরি করেনি তৃণমূল (TMC)। দলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক তথা মুখপাত্র কুণাল ঘোষের (Kunal Ghosh)বক্তব্য, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে অবমাননাকর মন্তব্য করেছেন শুভেন্দু অধিকারী। রামের নাম করে অসৌজন্যতা, অসভ্যতা। বিরোধী দলনেতা যে বক্তব্য রেখেছেন তা অত্যন্ত কুরুচিকর ও নিম্নমানের। উনি (শুভেন্দু) আদৌ বিধায়ক কি না তা আদালতের বিচারাধীন। মুখ্যমন্ত্রীকে বিরোধী দলনেতা আপনি নয়, তুমি বলে সম্বোধন করেছেন। যে সারাক্ষণ এরকম আমিত্ব করে যায়, তিনি বানর সেনার ডিফেক্টিভ বাঁদর।’’ সরকারি অনুষ্ঠানে স্লোগান নিয়ে যখন অস্বস্তিতে রেলমন্ত্রী অশ্বিণী বৈষ্ণব স্বয়ং, তখন শুভেন্দুর এভাবে মুখ্যমন্ত্রীকে আক্রমণ নিয়ে দলের মধ্যে অনেকেই ক্ষুব্ধ। কার্যত দু’ভাগ বিজেপি।
দলের একাংশের বক্তব্য, সরকারি অনুষ্ঠানের শেষে মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে অপমানজনক মন্তব্য করে সরকারি অনুষ্ঠানকে রাজনৈতিক তকমা দিয়ে দিয়েছেন শুভেন্দু। এদিকে, সরকারি অনুষ্ঠানে এই স্লোগান দেওয়া উচিত হয়নি বলে প্রকাশ্যেই বলেছেন বিজেপিরই সাংসদ এস এস আলুওয়ালিয়া। শুভেন্দুর মতো সরকারি অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক স্লোগানদাতাদের পাশে দাঁড়াননি বিজেপি সাংসদ।
বর্ধমান-দুর্গাপুর লোকসভা কেন্দ্রের সাংসদ এসএস আলুওয়ালিয়া রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে এই স্লোগানে আপত্তি জানিয়ে বলেন, ‘‘রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে ভারত মাতা কি জয় স্লোগান দেওয়াই উচিত ছিল।’’ আবার বিজেপি পরিষদীয় দলের মুখ্য সচেতক মনোজ টিগ্গার বক্তব্য, ‘‘যারা এই স্লোগান দিয়েছে তারা দলের কেউ নাও হতে পারে। কড়া নিরাপত্তার মধ্যে তারা কীভাবে ভিতরে এল সেটাই প্রশ্ন।’’ অর্থাৎ, মনোজও বুঝিয়ে দিয়েছেন, এই স্লোগান দেওয়ার উপযুক্ত জায়গা এটা নয়। সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায় প্রকাশ্যে বলেছেন, আবেগ থেকেই এরকম স্লোগান বলে ফেলেছে।
মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্কে শুভেন্দুর মতো অসম্মানজনক কথা এদিন বিজেপির কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বা সাংসদরা কেউ বলেননি। আলুওয়ালিয়া থেকে মনোজরা প্রকাশ্যেই জানিয়েছেন, বিষয়টা কার্যত ঠিক হয়নি বলে জানিয়েছেন। আর গেরুয়া শিবিরের অন্য অনেকেই স্লোগান দেওয়ার বিষয়টা যে সমর্থনযোগ্য নয় এবং সরকারি অনুষ্ঠানস্থলে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে শুভেন্দুর আক্রমণ করাটাও যে ঠিক হয়নি সেটাও দলের অন্দরেও বলছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিজেপির আর এক সাংসদ ঘনিষ্ঠ মহলে বলেছেন, রেলের অনুষ্ঠান। সরকারি মঞ্চ। সেখানে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান বলার উপযুক্ত জায়গা নয়। বিজেপির এক রাজ্য নেতার কথায়, ”আমরা রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে জয় শ্রীরাম স্লোগান দিয়ে থাকি। কিন্তু কোনও সরকারি অনুষ্ঠানে সেটা দেওয়াটা ঠিক নয়। ভারত মাতার জয় বলা যেতে পারেই। তাতে কোনও আপত্তি ছিল না। শুভেন্দু অধিকারীরও উচিত হয়নি কোনও সরকারি অনুষ্ঠানের শেষে সেখানে সংবাদ মাধ্যমের সামনে মুখ্যমন্ত্রীর সম্পর্কে অসম্মানজনক কথা বলা। এসব ঘটনায় দলেরই মুখ পুড়ছে।”
আরেক রাজ্য নেতার কথায়, ”যারা স্লোগান দিয়ে দলের মুখ পোড়াল তারা বিরোধী দলনেতার ঘনিষ্ঠ হাওড়ার এক বিজেপি নেতার লোকজন। পরিকল্পনা করেই তাদের আনা হয়েছে।” কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুভাষ সরকারের বক্তব্য, ‘‘জয় শ্রীরাম স্লোগান উন্মাদনার মধ্যেই বলেছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে সকলকে থামতে বলি। স্লোগান বন্ধ করার অনুরোধ করি।’’
বিজেপি সূত্রে খবর, ২৩ নম্বর প্ল্যাটফর্মে দর্শকাসনে কারা স্লোগান দিয়েছিল, সেটা নিয়ে খোঁজখবর নিচ্ছে দলের শীর্ষনেতৃত্ব। কারণ, রেলমন্ত্রী স্বয়ং হাতজোড় করে অনুরোধ করার পরও স্লোগান থামাননি বিজেপির ওই কর্মী-সমর্থকরা। খবর, সরকারি অনুষ্ঠানে এইভাবে স্লোগান দেওয়াটা সমর্থন করছে না বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। প্রশ্ন এটাও, এই ঘটনা কি পূর্ব পরিকল্পিত ছিল? স্লোগান দিতে হবে এটা কি আগে থেকে ঠিক করেই ওই কর্মীরা এসেছিল? পাশাপাশি এই প্রশ্ন উঠেছে, যেখান থেকে স্লোগান উঠছিল সেখানে বিজেপির একাধিক সাংসদ, বিধায়ক থেকে রাজ্য নেতারাও উপস্থিত ছিলেন। রেলমন্ত্রী যখন থামতে অনুরোধ করছেন, তখন সেখানে উপস্থিত দলের জনপ্রতিনিধি ও রাজ্য নেতারা ওই স্লোগানকারীদের থামানোর চেষ্টা করলেন না কেন? তাহলে কি ওই কর্মীদের উপর দলের নেতাদের কোনও নিয়ন্ত্রণই ছিল না?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.