গৌতম ব্রহ্ম: জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ভারতের প্রকৃত রূপ চিনিয়েছে। শিখিয়েছে বহুত্ববাদ। আর তিনি নিজেকে তুলে ধরেছেন গোটা বিশ্বের কাছে। আজ সেই প্রিয় জেএনইউ ক্যাম্পাস সংঘর্ষে দীর্ণ, রক্তাক্ত। যে ছবি অবিরত ‘রক্তাক্ত’ করছে তাঁকেও। তিনি ব্যথিত, আতঙ্কিত। জেএনইউ-তে মুখ ঢাকা ‘বহিরাগত’দের হামলায় ছাত্র সংসদের সভানেত্রী ঐশীর মাথা ফেটে যাওয়া, অধ্যাপিকা সুচরিতা সেনের আক্রান্ত হওয়ার খবর পেয়ে সংবাদ প্রতিদিনকে একান্তভাবে নিজের উদ্বেগের কথা প্রকাশ করলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়।
রবিবার সন্ধেবেলা জেএনইউ-য়ের অন্তত তিনটি গার্লস হস্টেলে মুখে ঢেকে ঢুকে ‘বহিরাগত’রা তাণ্ডব চালায় বলে অভিযোগ। এসএফআই সভানেত্রী ঐশী ঘোষের মাথা ফেটে যায়। যন্ত্রণায় তাঁর কথা বন্ধ হয়ে যায় প্রায়। তাঁকে এইমসে ভরতি করানো হলে, মাথায় ১৫টি সেলাইয়ের পর ছাড়া হয়। রবিবার সন্ধে গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে যখন টেলিভিশনের পর্দায় এমন হৃদয়বিদারক দৃশ্য ভেসে উঠছে বারবার, ঠিক তখনই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী তথা নোবেলজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে সংবাদ প্রতিদিন। তিনি তখন দিল্লি থেকে সাড়ে ১১ হাজার কিলোমিটার দূরে, বস্টনে নিজের কাজে ব্যস্ত। তাঁকে খবর দেওয়া হয়, কীভাবে তাণ্ডব চলেছে ক্যাম্পাসের ভিতরে, পাঠানো হয় হামলার ফুটেজ এবং ছবি। আর সেসব দেখে জেএনইউ-য়ের এই বিশ্ববরেণ্য প্রাক্তনী প্রতিক্রিয়া দিতে দেরি করেননি। এসব দেখেশুনে তিনি যে কতটা আহত, তার গোপনে রাখেননি।
সংবাদ প্রতিদিনকে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ বলেন, ”এই ঘটনায় আমি মর্মাহত, আতঙ্কিতও। দোষারোপ, পালটা দোষারোপ চলবেই। কিন্তু তারই মাঝে আমাদের প্রকৃত সত্যটা খুঁজে বের করতে হবে। দোষীদের স্পষ্ট বুঝিয়ে দিতে হবে যে এসব কোনওভাবেই বরদাস্ত করা হবে না।” জেএনইউ আর অভিজিতের সম্পর্কটা আসলে এমনই। শুধু উচ্চশিক্ষাই নয়, এই বিশ্ববিদ্যালয় তো তাঁর জীবন অনেকটাই গড়ে দিয়েছে। তাই নোবেলজয়ের পর দেশে পা দিয়েই ছুটেছিলেন প্রিয় ক্যাম্পাসে। টিটি খেলে, আড্ডা দিয়ে, নতুন প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে ছবি তুলে সময় কাটিয়েছিলেন অনেকটাই। সেই ক্যাম্পাসের এমন রক্তাক্ত ছবি তার মর্মে আঘাত করবেই।
JNU-তে পড়াকালীন এই নোবেলজয়ী বাঙালি রীতিমত সক্রিয়ভাবে ছাত্র রাজনীতিতে যোগ দেন। আন্দোলনে শামিল হয়ে তিহার জেলেও বন্দি ছিলেন। ফলে ছাত্র রাজনীতির এপিঠ-ওপিঠ তাঁর বেশ ভালভাবে জানা। আজ দেশের যিনি অর্থমন্ত্রী, সেই নির্মলা সীতারমণ ছিলেন তাঁর সহপাঠী। তাই দেশে ফিরে নির্মলার প্রশংসা কিন্তু সেদিনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে আজকের ছবি যে কিছুতেই মিলছে না! আর এটাই বোধহয় অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়কে এতটা রক্তাক্ত করে তুলেছে।
ছাত্রজীবনে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত পরবর্তী সময়ে তিনি সেখান থেকে সরে গিয়েছেন। দেশের দারিদ্র দূরীকরণে মনোনিবেশ করেছেন গবেষণায়। যার সুফল – নোবেলজয়। তাই দেশে ফেরার পর বামপন্থী ভাবধারায় বিশ্বাসী বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা করলেও, এড়িয়ে গিয়েছেন প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক সংসর্গ। দেখা করেছেন শুধুমাত্র দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে। দু’জনের মধ্যে স্বাস্থ্যকর আলোচনাও হয়েছে। এনিয়ে কেউ কেউ কটাক্ষ করলেও তিনি হেলায় তা উপেক্ষা করেছেন। কারণ, তিনি জানতেন যে তিনি দেশের প্রশাসনিক প্রধানের সঙ্গেই আলোচনায় বসেছেন, যার সঙ্গে রাজনীতির যোগাযোগ বললে ভুল হবে। আসলে, দূরে থাকলেও মন তাঁর পড়ে রয়েছে এদেশেই। তাই তো নিজের প্রিয়তম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিস্থিতিতে এতটা গভীর বেদনা অনুভব করছেন নোবেলজয়ী বঙ্গসন্তান।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.