গৌতম ব্রহ্ম: আশঙ্কাই সত্যি হল! মানুষের শরীরে সন্ধান মিলল ভাগাড়ে থাকা ভয়ংকর জীবাণুর। টক্সোপ্লাজমোসিসে আক্রান্ত হলেন ১৪ জন। আক্রান্তরা সবাই দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা। কারও বাড়ি গড়িয়া-যাদবপুর, কারও টালিগঞ্জ। প্রত্যেকের শরীরেই বিপজ্জনক মাত্রায় মিলল ‘টক্সোপ্লাজমা গোন্ডি’। এই ‘প্যারাসাইট’ বা পরজীবী মূলত বিড়ালের শরীরে থাকে। বিড়ালের মাংস বা বিষ্ঠা থেকে মানুষের মধ্যে ছড়ায়।
এমন ঘটনা অত্যন্ত বিরল বলেই জানিয়েছেন চিকিৎসক-বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের আশঙ্কা, ভাগাড়-কাণ্ডের জেরে কলকাতার বহু মানুষ এমন টক্সোপ্লাজমোসিসে আক্রান্ত হয়েছেন। দক্ষিণ কলকাতার যোধপুর পার্কের একটি বেসরকারি ডায়াগনস্টিক ল্যাবের অভিজ্ঞতা অন্তত তাই বলছে। ল্যাবের কর্ণধার ডা. অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, “গত দু’বছরে এফএনএসি পরীক্ষা করতে গিয়ে ১৪টি নমুনায় টক্সোপ্লাজমা পেয়েছি। রোগীরা সবাই যাদবপুর, গড়িয়া, টালিগঞ্জের। এফএনএসি-তে এই পরজীবীর অস্তিত্ব মেলা খুবই বিরল। উৎসটা নিয়ে এবার সন্দেহ হচ্ছে।”
[ভাগাড়ের মাংস কীভাবে পৌঁছাত রেস্তরাঁয়? সন্ধানে মরিয়া পুলিশ]
জানা গিয়েছে, টক্সোপ্লাজমোসিসে আক্রান্ত ১৪ জন রোগীর মধ্যে অনেকেরই বিড়ালের সঙ্গে কোনও সংস্রব নেই। তা সত্ত্বেও বিড়ালের বিষ্ঠায় থাকা জীবাণু মানবদেহে! ধন্দ তৈরি হয়েছিল প্যাথোলজিস্টদের মধ্যে। ভাগাড়কাণ্ড সেই ধন্দ কাটিয়ে দিল। চিকিৎসকদের দৃঢ় বিশ্বাস, ভাগাড়ের দূষিত মাংসের হাত ধরেই মানুষের শরীরে বাসা বেঁধেছে বিড়ালের বিষ্ঠায় থাকা পরজীবী।
ভাগাড়ের মাংস থেকে কী কী রোগ হতে পারে, এতদিন এই নিয়ে জল্পনা চলছিল। কিন্তু, ইতিমধ্যেই বহু মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন, এ তথ্য প্রকাশ্যে এল এই প্রথম। ডাক্তারদের আশঙ্কা, একটি ল্যাবেই পশু থেকে মানুষে সংক্রামিত ১৪টি ‘জুনোসিস’ পাওয়া গেল। তাহলে কলকাতায় তো বহু মানুষ জুনোসিসে আক্রান্ত হয়ে বসে আছেন। কাঁপুনি ধরেছে বিশেষজ্ঞদের মনে। তাঁদের মত, মানুষের শরীরে ঢুকে এই পরজীবী কী খেল দেখাবে কে জানে? অবিলম্বে রোগীদের খুঁজে বের করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা উচিত।
দু’ভাবে এই পরজীবী মানবদেহে অনুপ্রবেশ করতে পারে। সম্ভাবনা এক, ভাগাড় থেকে সংগৃহীত বিড়ালের মাংসের কাবাব খেয়ে। সম্ভাবনা দুই, ভাগাড়ে প্রচুর বিড়াল বিষ্ঠা ত্যাগ করে। ভাগাড়ে পরা অন্য মাংসের সঙ্গে সেই বিষ্ঠা মিশে যেতে পারে। সম্ভাবনা তিন, অনেকেই বাড়িতে বিড়াল পোষেন। নিজের হাতে বিড়ালের বিষ্ঠা পরিষ্কার করেন। তার থেকেও পরজীবী মানুষের শরীরে ঢুকতে পারে। তবে, বিড়ালের মাংস থেকে তৈরি ‘কাবাব জাতীয় খাবার মারফত অনুপ্রবেশের সম্ভাবনাই বেশি। এমনটাই জানিয়েছেন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. অরিন্দম বিশ্বাস। তাঁর মত, বার্ড ফ্লু, ব্রুসেল্লা, সোয়াইন ফ্লু তো একটা সময় পশুর থেকেই মানুষের শরীরে এসেছে। সুতরাং ভাগাড়-কাণ্ড ভারতে নতুন ধরনের ‘জুনোসিস’-এর জন্ম দিতেই পারে।
[চালকের কানে মোবাইল, ডিভাইডারে ধাক্কা মেরে উলটে গেল গাড়ি]
এবার আসা যাক এই পরজীবীর ছোবলে কী কী হয়?
জ্বর, গায়ে ব্যথা, গ্ল্যান্ড ফুলে যাওয়া, পেট ব্যথা। সাধারণভাবে এগুলিই উপসর্গ। তবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম (যেমন ক্যানসার বা এডস আক্রান্ত, স্টেরয়েড থেরাপি চলা রোগী) এমন রোগীদের শরীরে বিপর্যয় আনতে পারে এই পরজীবী। মৃগী রোগীর মতো খিঁচুনি থেকে শুরু করে স্নায়ুরোগ, অনেক কিছুই হতে পারে। ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে রেটিনা। এমনটাই জানালেন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. অরিন্দম বিশ্বাস। তবে, টক্সোপ্লাজমোসিস সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে গর্ভস্থ শিশুর। ‘অ্যাসিম্পটোমেটিক’ উপসর্গ হওয়ায় গর্ভবর্তী মহিলা এই রোগের কিছু টের পান না। কিন্তু, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তৈরির সময় এই পরজীবী গর্ভস্থ ভ্রুণের মধ্যে বিকৃতির জন্ম দিতে পারে। এমনটাই জানালেন বিশিষ্ট শিশু বিশেষজ্ঞ তথা ক্রিটিক্যাল কেয়ার স্পেশালিস্ট ডা. প্রভাসপ্রসূণ গিরি। তাঁর মত, এখন কলকাতায় প্রচুর মানুষের কিডনি প্রতিস্থাপন হচ্ছে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে রাখা হয় বলে এদের ক্ষেত্রেও বিপজ্জনক হতে পারে টক্সোপ্লাজমোসিস।
এমনিতে এই পরজীবীর সঙ্গে মানুষের সখ্য নতুন নয়। বিশ্বের অনেক দেশেই এই পরজীবীর দাপট বেশি। কিন্তু, ভারতে অত্যন্ত বিরল। পাওয়া যায় না বললেই চলে। সেক্ষেত্রে একটি ল্যাবেই এতগুলি নমুনা ‘পজিটিভ’। চিকিৎসকদের আশঙ্কা, খুঁজলে এমন নমুনা নিশ্চয়ই আরও অনেক মিলবে।
[পুলিশ কোয়ার্টার থেকে উদ্ধার রক্তাক্ত কনস্টেবল, চাঞ্চল্য ছড়াল কাশীপুরে]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.