ক্ষীরোদ ভট্টাচার্য: বেঁচে থাকা তো কত ধরনের হয়? কিন্তু একা, নিঃসঙ্গ, অনাত্মীয় হয়ে রোজ ভেন্টিলেশনে বেঁচে থাকা! এ কেমন বাঁচা? টানা চোদ্দো বছর সজ্ঞানে এইভাবে বেঁচে থাকা কতটা ভয়াবহ? প্রতি মুহূর্তে জীবন দিয়ে বুঝছে সোনু যাদব। বেঁচে থাকার এমন অসম লড়াই দেখছে বাঙ্গুর ইনস্টিটিউট অফ নিউরোলজি!
হাওড়ার ব্যাঁটরায় থাকত সোনু। এখন বয়স ২৪। ২০০৯ সালের ২৯ জুন সোনুর দলা পাকানো শরীরটা বাঙুর ইনস্টিটিউট অফ নিউরোলজির আইসিইউতে যেদিন আনা হয় তখন বয়স দশ। মাঝের ১৪ বছরে রোজ অন্তত কয়েক ঘণ্টার জন্য তাঁকে ভেন্টিলেশনে থাকতে হয়েছে। না হলে থেমে যাবে হৃদস্পন্দন। কিন্তু কেন? সোনু নিজে থেকে শ্বাস নিতে পারে না। নড়াচড়া তো দূর-অস্ত! সোনুর মেরুদণ্ডর দ্বিতীয় হাড় প্রথম হাড়ের উপর এমনভাবে চেপে বসেছে যে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র পুরো অকেজো। মাঝে একবার অস্ত্রোপচার হয়েছিল। সেই উদ্যোগ ব্যর্থ। বেঙ্গালুরুর ইনস্টিটিউট অফ নিউরো সায়েন্স রিপোর্ট দেখে কোনও ভরসা দিতে পারেনি। তাই আইসিইউতে একই বেডে টানা চোদ্দো বছর সোনু! বুক ভরে শ্বাস নিতে পারে না। গলায় ট্রাকোস্ট্রমি। নল বেরিয়ে গেছে। খাইয়ে দিতে হয়।
বেডসোর আটকাতে নিয়ম করে ম্যাট্রেস বদলে দেন নার্স দিদিরা। বিআইএনের নিউরো সার্জারি প্রধান শুভাশিস ঘোষ বলেছেন, ‘‘ডাক্তারি পরিভাষায় এমন রোগের নাম ‘অ্যাটল্যান্টো-এক্সিয়াল ডিসলোকেশন’। ওকে ওষুধ খেতে হয় না। কিন্তু নিজের থেকে শ্বাসটুকুও নিতে পারে না। তাই যতদিন বাঁচবে ভেন্টিলেশনে থাকতে হবে। সোনু সব দেখে। বোঝে। আগে কাঁদত। এখন নিজের ভবিতব্য দেখে নিজেই হাসে।’’ টানা চোদ্দো বছর দেশের কোনও সরকারি হাসপাতালে নিখরচায় এমন চিকিৎসাধীন থাকার নজির নেই। শুভাশিসবাবু বলেন, ‘‘ও তো বিআইএনের সদস্য। কোথায় যাবে? কে ওর দেখভাল করবে?’’ স্বাস্থ্যভবন বলছে, এর আগে মুম্বইয়ের এক নার্স অজ্ঞান অবস্থায় ট্রমা কেয়ারে প্রায় ১৮ বছর ছিলেন। হাসপাতালের আরেক তরুণ চিকিৎসক ময়াঙ্ক চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘কিছু ক্ষেত্রে জন্মগত ত্রুটি, আবার উঁচু জায়গা থেকে পড়ে গেলেও এই রোগ হতে পারে। যতটুকু শুনেছি সোনুর জন্মগত সমস্যা।’’
চার দেওয়ালের হাসপাতালে নিজের মতো করে বেঁচে সোনু। আগন্তুক দেখে পাশে দাঁড়ানো নার্সের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি। পরে বলে, ‘‘ভালোই আছি।’’ বাড়িতে বাবা মা তিন ভাই আর দুই বোন। প্রথম দিকে নিয়ম করে সবাই আসত। এখন মাঝে মধ্যে মা আর সেজদা আসে। সিস্টাররাই পালা করে দেখভাল করে সোনুকে। এক বেডে এত বছর কোনও সংক্রমণ হয়নি। কেউ বিরক্তও হয়নি। রোজ একজন করে ডাক্তারবাবুকে আসতেই হবে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে হবে–সোনু ভাইয়ের একমাত্র দাবি মেনে নিয়েছে এস এস কে এম হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কয়েকদিন হল স্মার্ট ফোনের আবদার করেছে সোনু। সিনেমা দেখবে। সময় যে আর কাটতেই চায় না। কিন্তু আইসিইউতে ইন্টারনেট সমস্যা, তাই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যুবকের জন্য রেডিওর ব্যবস্থা করবে। হাসপাতালের এক কর্তা বলেন, ‘‘সামান্য লাভ ক্ষতি নিয়ে নিত্য বিবাদ আমাদের। সেই সময়ে চার দেওয়ালের মধ্যে ওর বেঁচে থাকার লড়াই আমাদের ভালো থাকতে শিখিয়েছে।’’
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.