ধ্রুবজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়: আমরা নির্বাচন লড়ি জেতার জন্য। হারলে হারব। লড়াই তবু জারি থাকবে। নির্বাচনও একটা লড়াই। সেই পথেই বিপ্লব আসবে। চব্বিশের নির্বাচনে বামপন্থী দলগুলোর মধ্যে সব থেকে বেশি আসনে প্রার্থী দিয়ে এটাই বক্তব্য এসইউসিআইর (SUCI)। গোটা দেশে তারা ১৫১টি প্রার্থী দিয়েছে, এ রাজ্যে ৪২। যেখানে গোটা সিপিএম ৫২। ইন্ডিয়া জোটের শরিক তারা। গোটা হিন্দি বলয়ে তাদের প্রার্থী নেই।
এর পরও জনসমর্থনের ভিত্তিতে এসইউসিআইর জয় নিয়ে সংশয় থেকে যায়। তাদের রাজ্য সম্পাদক চণ্ডীদাস ভট্টাচার্যর কথায়, “মনে রাখবেন আমরাও নির্বাচনে যোগদান করি জেতার জন্যই। বেশি ভোট পাওয়ার জন্যই। যখন লড়ি সেভাবেই লড়ি।” তাঁর কথায়, “যে দলই জিতুক, দেশে যারা উৎপাদন ব্যবস্থার মালিক যারা তাদের কোনও পরিবর্তন হয় না। রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে লড়াইয়ে তার পরিবর্তন সম্ভব। এই লড়াই লড়তে লড়তেই নির্বাচন আসে। নির্বাচনকে আমরা তাই লড়াইয়ের দৃষ্টিতেই দেখি।”
কিন্তু বারবার হারের পর তো মনোবল ভেঙে যাওয়ার কথা। উল্টোটা হয় কী করে? ৭৩ পেরিয়েছেন চণ্ডীদাস বাবু। দোহারা চেহারা, একরোখা জেদ। আপনারা কি জিততে চান না? বলেন, “চাইব না কেন? আজকেই চাই ক্ষমতায় আসতে। কিন্তু আদর্শ বাদ দিয়ে নয়। আমি লোকসভা (Lok Sabha 2024), বিধানসভায় গিয়ে জনগণের দাবিকে তুলে ধরব, নিজের ঘর গোছাব না। উদাহরণ আমাদের প্রত্যেক সাংসদ, বিধায়ক। এত ব্যতিক্রম তো হয় না। ব্যতিক্রমটা হল আমাদের আদর্শ। একজনও জিতলে আমরা গণকণ্ঠকে নিয়ে চলব। মানুষের আন্দোলনকে বড় করব।” তাঁর আক্ষেপ সিপিএম মার্কস, লেনিনের আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়েছিল বলেই এতদিন রাজত্ব করতে পেরেছে। পুঁজিপতি শ্রেণি তা না হলে তাদের টিকতে দিত না।
বারবার পুঁজিবাদী এই শ্রেণিকেই তাই সরানোর কথা বলেছেন এসইউসি রাজ্য সম্পাদক। তাঁর কথায়, “মনে রাখবেন পুঁজিবাদী শ্রেণী নির্বাচন ব্যবস্থা এনেছে। তারাই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রেখেছে, ভোটের অধিকার রেখেছে। অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর নির্ভর করে যে রাষ্ট্রব্যবস্থা তার পরিবর্তন দরকার। অগণিত লড়াই লড়তে লড়তেই সে পথে যেতে হবে। অসংখ্য সংগ্রামের পথ বেয়েই একদিন বিপ্লবের পথ আসে। এই লড়াইটাই ধীরে ধীরে গড়ে তুলতে হবে।” এই কারণেই বিপ্লবাত্মক মুক্তির কথা বারবার এসেছে তাঁর মুখে। বলেছেন, “পুঁজিবাদীদের বিরুদ্ধে বিপ্লবাত্মক পরিবর্তনই হল একমাত্র মুক্তির পথ। সেটা তো চাইলেই হবে না। তার আগে বিস্তীর্ণ পথ।”
পুরোটাই যদি সত্যিই বিল্পবের জন্য হবে তবে তাকে বাস্তব করা কীভাবে সম্ভব? এতে তো পুঁজি নিশ্চয়ই অনেক দরকার। এত প্রার্থী ভোটে লড়ছেন। তাদের প্রচার খরচই বা কীভাবে আসবে? চণ্ডীদাসবাবুর কথায়, “বন্ড তো আমরা পাইনি। আমাদের দেবেই বা কে? কোনও কর্পোরেট হাউসও আমাদের চাঁদা দেয় না। আমরা হাওড়া, শিয়ালদহ স্টেশনে দাঁড়িয়ে, ট্রেনে চড়ে মানুষের কাছে চাঁদা তুলি। গণদাবী বিক্রি করি বাড়ি বাড়ি গিয়ে। আমাদের কথায় বিশ্বাস না করলে দেখে আসুন।” সিপিএমকেও কটাক্ষ করেন, “সিপিএম (CPIM) নির্বাচনী বন্ডে টাকা নেয়নি ঠিক। কিন্তু কর্পোরেট হাউস তো চাঁদা দিয়েছে। সিপিএমের কর্মী বন্ধুরা দুঃখ পেলেও এটা বাস্তব যে, কর্পোরেট হাউস তাদের চাঁদা দেয়। ৭৭-এ তাই আমাদের সিপিএম সঙ্গে নেয়নি। তখন তো জ্যোতিবাবু বলেছিলেন এসইউসি থাকলে আন্দোলন হবে।” তার পরও সংগ্রামী বামপন্থী ঐক্যের কথা বলেছেন তিনি। নতুন প্রজন্মকে সেই জায়গাটাই বোঝাতে চায় এসইউসি নেতৃত্ব। চণ্ডীদাসবাবুর কথায়, কারও মানবিক গুণের উপর তার চিন্তাশীলতার উপর ক্রিয়া করে এই বিপ্লবের পথ দেখাব আমরা।
এবারেও সেই সুযোগ আছে বলে তাঁর বিশ্বাস। গত যে কদফা ভোট হয়েছে তাতে খুব স্পষ্ট করে মেরুকরণ হয়নি বলেই মনে করেন তিনি। তাঁর কথায়, “অনেকের মধ্যে এখনও দ্বিধা আছে। শার্প পোলারাইজেশন হচ্ছে না। কাকে ভোট দেব! রাজ্যে ক্ষেত্রে সেটা মূলত তৃণমূল-বিজেপি। অনেকে ভাবছেন সর্ষে দিয়ে ভূত ছাড়াতে যাব। কিন্তু দেখা যাচ্ছে সর্ষের মধ্যেই ভূত। তাই ভোট শতাংশ কমে যাচ্ছে।” রাজ্যে বাম-কংগ্রেস জোটও ফলপ্রসূ হচ্ছে না বলে মত তাঁর। তিনি বলছেন, “বিমানবাবু আর প্রদীপবাবু যেদিন প্রচারে বেরিয়েছিলেন তার পর দিনই অনেক জায়গায় বাম কর্মী-সমর্থকরা উষ্মা প্রকাশ করেছেন। বিমানবাবু না বেরলেই পারতেন। পুরনো বামপন্থী যারা কংগ্রেসের সঙ্গে লড়াই করেছেন, তাদের পক্ষে এই জোট মেনে নেওয়া মুশকিল।”
কংগ্রেসের সঙ্গে জোট তাঁরা কেন মানতে পারছেন না? স্পষ্ট ব্যাখ্যায় সিপিএমের প্রসঙ্গ টেনে তাঁদের বক্তব্য, “সিপিএম বিজেপিকে ফ্যাসিস্ট শক্তি বলেছে। বিজেপির পরাজয় হওয়া দরকার। আবার যে পুঁজিপতি শ্রেণিকে রক্ষা করার জন্য বিজেপি ফ্যাসিস্ট, সবচেয়ে বেশিদিন রাজত্ব করে কংগ্রেস কিন্তু সেই ফ্যাসিবাদের পথকেই প্রশস্ত করেছে। দেশের পুঁজিপতি শ্রেণির মূল দুটি দল কংগ্রেস আর বিজেপি।” তাঁর কথায়, “সিপিএম বলেছিল ১৯৭২ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত কংগ্রেসের (Congress) হাতে তাদের ১১০০ কর্মী খুন হয়েছেন। বাবরি মসজিদের তালা খুলে সাম্প্রদায়িকতাকে নতুন করে উসকে দিয়েছিলেন রাজীব গান্ধী (Rajiv Gandhi)। আর পরের দিন টিভি দেখতে দেখতে বন্ধু অরুণ নেহরুকে বলেছিলেন, ‘ইটস আ গেম’। কী গেম? হিন্দুত্বের ভোট নেওয়ার গেম। সেই কংগ্রেসের সঙ্গে ঐক্য হয় কী করে?”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.