রূপায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়: শিক্ষিত, মার্জিত, তরুণ। বিজেপির নয়া রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারকে (Sukanta Majumdar) এভাবেই বর্ণনা করেছেন তাঁর পূর্বসূরি দিলীপ ঘোষ। গেরুয়া শিবির সূত্রে বলা হচ্ছে, ভোটে অভীষ্ট লক্ষ্যপূরণ না হওয়ায় দলের সংগঠনের খোলনলচে বদলাতেই হত। সেকারণেই নতুন সভাপতি আনা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, রাজ্য সভাপতি পদে আরও অনেক জনপ্রিয় মুখ থাকা সত্ত্বেও অপেক্ষাকৃত অনভিজ্ঞ, তথা তরুণ সুকান্ত মজুমদারকেই কেন বাছা হল? এর নেপথ্যে বেশ কয়েকটি ব্যাখ্যা দিচ্ছে রাজনৈতিক মহল।
প্রথমত, এরাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের (TMC) মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে শীর্ষ নেতাদের অধিকাংশই কলকাতা বা শহরতলির বাসিন্দা। শুধু তৃণমূল বলে না, বাম আমল থেকেই রাজ্যের রাজনীতি মূলত ছিল কলকাতা কেন্দ্রিক। এক্ষেত্রে রাজ্যের অন্যান্য জেলার বহু বাসিন্দাই নিজেদের বঞ্চিত বলে মনে করেন। বিজেপি মূলত জেলার সেই সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগাতেই জেলা থেকে রাজ্য সভাপতি নিয়োগ করার পন্থা নিয়েছে। শুধু রাজ্য সভাপতি নন, বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীও (Suvendu Adhikari) জেলার বাসিন্দা। সুকান্তকে রাজ্য সভাপতি নিয়োগ করে আসলে সেই জেলাকেন্দ্রীক রাজনীতিকেই আরও বেশি প্রাধান্য দিতে চাইছে গেরুয়া শিবির।
দ্বিতীয়ত, উত্তর এবং দক্ষিণবঙ্গের সমীকরণ। বাংলার রাজনীতিতে বিজেপির (BJP) উত্থানের শুরুই হয়েছে উত্তরবঙ্গ দিয়ে। পরবর্তী কালে গেরুয়া শিবিরের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া শুরু করে উত্তরবঙ্গকে। আসলে, উত্তরবঙ্গের মানুষের দীর্ঘদিনের অভিযোগ, রাজধানী থেকে অনেক দূরে থাকায় উন্নয়নের ক্ষেত্রে তাঁদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। সেই অভিযোগকেই কাজে লাগাতে চেয়েছিল গেরুয়া শিবির। যার ফল মেলে ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনেও। উত্তরবঙ্গে অভাবনীয় ফল করে বিজেপি। ২০২১ বিধানসভায় রাজ্যের অন্যান্য প্রান্তে বিজেপির ভোট ব্যাপক হারে কমলেও, উত্তরবঙ্গে ভোটহ্রাসের পরিমাণ ছিল অন্য এলাকার থেকে কম। সম্ভবত সেকারণেই উত্তরবঙ্গকে ‘বেস ক্যাম্প’ হিসাবে ব্যবহার করতে চাইছে বঙ্গ বিজেপি। এমনকী, কদিন আগে বঙ্গভঙ্গের তত্ত্ব খাঁড়া করা জন বারলাকেও কেন্দ্রীয় মন্ত্রিত্ব দিয়েছে গেরুয়া শিবিরের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। এবার উত্তরবঙ্গ থেকে রাজ্য সভাপতিও করে দেওয়া হল। এতে উত্তরে সংগঠন আরও পোক্ত হবে বলে মনে করছে দল।
তৃতীয়ত, সুকান্ত মজুমদারকে দলের সব গোষ্ঠীর কাছে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। আসলে, বঙ্গ বিজেপির অন্দরে গোষ্ঠীবাজি বা লবিবাজি চলে আসছে সেই বিষ্ণুকান্ত শাস্ত্রীর আমল থেকেই। দিলীপ ঘোষকেও (Dilip Ghosh) এতদিন কাজ করতে হয়েছে সেই লবিবাজি সামলেই। সুকান্ত মজুমদারের অ্যাডভান্টেজ হল, তাঁর নিজস্ব কোনও গোষ্ঠী নেই। দিলীপ, শুভেন্দু, তথাগত, সবার সঙ্গেই সামঞ্জস্য রেখে চলতে পারবেন তিনি। দলের সদ্য প্রাক্তন সভাপতি দিলীপ ঘোষই নাকি তাঁর নামটি প্রস্তাব করেন। তাছাড়া, অপেক্ষাকৃত লো-প্রোফাইল হওয়ায় সবার কাছে তিনি গ্রহণযোগ্য হবেন বলেই মনে করছে দল। তাছাড়া, সুকান্তবাবু নিজে আরএসএসের (RSS) ঘনিষ্ঠ। তাই সংঘ পরিবার থেকেও তাঁর নিযুক্তিতে সম্মতি দেওয়া হয়েছে।
এছাড়াও সুকান্ত মজুমদার অপেক্ষাকৃত তরুণ, শিক্ষিত এবং সমাজের সব স্তরের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবেন বলে মত বিজেপি নেতার। দিলীপ ঘোষ রাজ্য সভাপতি থাকাকালীন তাঁর একের পর এক আলটপকা মন্তব্য দলের কর্মীদের মনোবল বাড়ালেও তথাকথিত ‘এলিট ক্লাসে’র বাঙালিদের কাছে বিজেপিকে একপ্রকার অচ্ছ্যুত করে তুলেছিল। সুকান্তর আমলে অন্তত তেমনটা হবে না বলেই মনে করছে বিজেপি। তাছাড়া, সুকান্তর বয়স কম হওয়ায় আগামী দিনে দল তাঁকে ঘিরেই মমতাকে হারানোর রণকৌশল তৈরি করতে চাইছে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.